রাষ্ট্র ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতা

রাষ্ট্র ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতা- রা্ষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে চলমান যে বিতর্ক, তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই বিতর্কের ঐতিহাসিক পটভূমিটাও একটু জানা দরকার। 
রাষ্ট্র ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতা

বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এ উপমহাদেশের জনগণের দু’শতাব্দীকাল ব্যাপী চলমান স্বাধীনতা সংগ্রাম এর মধ্যে দিয়ে  জন্ম নেয়-দ্বি-জাতি তত্ত্ব। সে দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে, নানা রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে, শেষ পর্যন্ত ভারত যখন ভাগ হয়ে -জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান।

সুতরাং , সাধারন ভাবেই পাকিস্তানের ভিত্তি ছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব। অর্থ্যাৎ মুসলমান একটি আলাদা জাতি-এ বোধটি তাদের মধ্যে গোঁড়া থেকেই ছিল। জন্মগতভাবেই পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয়রাষ্ট্র ।

জন্ম থেকে অদ্যাবধি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তার জন্মগত নিকৃষ্ট  অবয়ব থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। কিন্তু  পাকিস্তানের জনক এবং দ্বি-জাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,স্বাধীন  পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে, (১১ই আগস্ট, ১৯৪৭ ইং)তার প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন- সময়ের ব্যবধানে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমানেরাও আর মুসলমান থাকবে না-ধর্মীয় অর্থে নয়। কারণ ধর্ম হল মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার-একটি জাতির সদস্য হিসাবে-তথা রাজনৈতিক অর্থে-পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে।”

অর্থাৎ, ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিলেও জিন্নাহ সাহেব কিন্তু  পাকিস্তানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন। এমনকি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খানও ছিলেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থক।

পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করলেও তারা কিন্তু কখনোই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন নি। ধর্মভিত্তিক দলগুলো বিশেষভাবে ‘জামায়াতে ইসলাম’ ও ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ এই দল গুলো পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধীতা করলেও  পাকিস্তান সৃষ্টির পর তারা খুব সুন্দর ভাবে রাজনৈতিক অঙ্গণে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিল-সে ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও চমকপ্রদ।

পাকিস্তান-আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধীতার কারণে ‘জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ প্রভৃতি ধর্মীয় দলগুলো স্বাধীন পাকিস্তানে অত্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়ে । তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার জন্য তাদের কাছে একটাই পথ খোলা ছিল , তা হলো- কোন নতুন ধর্মীয় ইস্যূ।

এমতাবস্থায় "কাদিয়ানিরা মুসলমান নহে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে" -এ রকম একটি অবাস্তব, সদ্যস্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন ইস্যুকে সামনে এনে  তারা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

 ১৯৪৯ ইং সালে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবী করে ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ সংগঠনটি কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার আহ্ববান করে। এই ন্যক্কারজনক কান্ডে  তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ‘জামায়াতে ইসলামী’ ও তাদের তাত্ত্বিকগুরু মৌলানা মওদুদী । 

তাদের  উস্কানীতে পাঞ্জাবে শুরু হয় কাদিয়ানি বিরোধী দাঙ্গা, যা লাহোরেও দ্রুত  ছড়িয়ে পড়ে।   এ দাঙ্গা এবং তা ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং  দীর্ঘ ৪ বৎসর বছর ব্যাপী চলার পর ১৯৫৩ ইং সালে দাঙ্গা এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, পাকিস্তানী সরকার লাহোরে সামরিক শাসন জারী করতে বাধ্য হয়। এ দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। 

দাঙ্গার বিষয়ে তদন্তের জন্য সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয় এবং  বিচারে দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ উস্কানী প্রদানের জন্য মৌলানা মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া এবং বিশেষভাবে সৌদি বাদশাহ এর হস্তক্ষেপে মওকুফ করা হয়।

পরিস্থিতি সামরিক শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের খুশী করার জন্য এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমর্থনের আশায়, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খান পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য অবজেকটিভ রেজুলেশন যুক্ত করলেন। যেখানে  বলা হল-"পাকিস্তানের সংবিধানে কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোন ধারা থাকতে পারবে না" । 

অত:পর পাকিস্তানের সংবিধানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি যোগ করা হল। এমনকি  কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোন ধারা আছে কিনা, তা পরীক্ষা করার জন্য আলেমদের নিয়ে একটি ওলেমা পরিষদ ও গঠন করা হল।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নির্লজ্জ ভাবে এভাবেই মৌলবাদীদের সাথে  আপোষ করলেন। আর এভাবেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে জায়গা করে নিল ধর্ম  এবং মৌলবাদীরা এটাকে তাদের জয় ভেবে উল্লসিত হল।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হল, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করেও লিয়াকত আলী খান কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতেতো পারেন নি। আততায়ীর নির্মম গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।

অত:পর যা হওয়ার তাই হতে লাগল। শুরু হলো  প্রাসাদ রাজনীতি, ক্ষমতা দখল ও পাল্টা দখলের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র।
দেশের হাল ধরার জন্য ইস্কান্দর মীর্জাকে  প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনীর প্রধান আইউব খান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হল। কিন্তু  মাত্র ৩০ মাসের মাথায় ইস্কান্দর মীর্জাকে তাড়িয়ে আইউব খাঁনের ক্ষমতা গ্রহণ, ইত্যাদি নাটক চলতে লাগল দ্রুত লয়ে।

তবে অবাক ব্যাপার হল, এসব পরিবর্তনের সাথে্ পাকিস্তানের আমজনগনের কোন সম্পর্ক ছিল না। তারা  বুঝতেও পারত না, কোত্থেকে কি হচ্ছে। সবকিছু ঘটছিল পর্দার অন্তরালে। এভাবে নাট্যশালার গ্রীণরুমে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ মল্লযুদ্ধে বিজয়ী এবং নাটেরগুরু জেনারেল আইউব খান পাকিস্তানের ভাগ্য বিধাতা হিসাবে আবির্ভূত হলেন ১৯৫৮ ইং সালের অক্টোবর মাসে।

বৃটিশ ভাবধারায় শিক্ষিত জেনারেল আইউব, পাকিস্তানের নাম থেকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ শব্দ বাদ দিলেন এবং  মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন করলেন। গোঁড়া মোল্লাদের প্রবল বিরোধীতা সত্ত্বেও , মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ জারী করলেন এবং মুসলিম পারিবারিক আইনে উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনলেন।

কিন্তু তার এ ধর্মনিরপেক্ষতার ভড়ং বেশীদিন টিকে নি। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারও সস্তা জনপ্রিয়তার প্রয়োজন হল। কিছু দিনের মধ্যে ১৯৬২ ইং সালের সংবিধান আবারো সংশোধন করে সংবিধানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি পুনরায় সংযুক্ত  করলেন।

তবে সবচেয়ে  চমকপ্রদ বিষয় হল-১৯৬৫ ইং সালে ফাতেমা জিন্নাহের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে গিয়ে একশ জন আলেম থেকে ফতোয়া আদায় করল- ইসলামী রাষ্ট্রে কোন মহিলা রাষ্ট্র প্রধান হতে পারবে না।

সকল বিরোধী দলের সমর্থন ও প্রচুর জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, নানা কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হল আইউব খান। তার এ বিজয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্র্মান্ধ মোল্লাদের অবস্থান আরো সুসংহত হল।

অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে-অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালিদের স্বাধিকার আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানী শাসকেরা বরাবরই ধর্মকে ঢাল এর মত ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে  ঠেকাতে গিয়ে যে গণহত্যা, নারীধর্ষণ তারা করেছে, সে সকল অপকর্মও তারা করেছে ধর্ম রক্ষার নামে।

অথচ ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তা যে  অসারতা, এটা প্রমাণ করে মাত্র ২৪ বৎসরের মাথায় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে গেল, আর জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

উপরোক্ত ইতিহাসের পরও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার বিপদ থেকে কোনো  শিক্ষা নেয়  নি পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ ও তাদের সামরিক জান্তারা্। বরং এই জঘন্যতম  পথেই পাকিস্তানের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকল।

সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে নির্বাচনে  জিতলেও জুলফিকার আলী ভূ্ট্টোর স্বৈরাচারী অপশাসন ও নির্বাচনী কারচুপির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো জোটবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে।  তখন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি পুনরায় ধর্মের ভেক ধরেন। 

ধর্মীয় দল গুলোকে হাতে নেওয়ার জন্য এবং আমজনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে, ভূট্টো কিছু শরীয়া আইন প্রণয়ন করলেন। ভূট্টোই প্রথম রাজনৈতিক নেতা যিনি  জামায়াতে ইসলামীর দাবী মোতাবেক কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঘোষণা করেন।

দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের বিরোধী রাজনীতিবিদরা  ভূট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য যা করে আসছিলেন  তার ষোলকলা পূর্ণ করলেন জেনারেল জিয়াউল হক। ভূট্টো কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঘোষণা করেছিলেন। জিয়াউল হক আরো একধাপ এগিয়ে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করলেন, তাদের চাকুরী থেকে অপসারণ করলেন, তাদের মসজিদ গুলো বন্ধ করে দিলেন, কাদিয়ানীদের আলাদা পরিচয় পত্র, আলাদা নির্বাচনী ব্যবস্থা করলেন। দেশে হুদুদ আইন চালু করে শরীয়া আদালত গঠন করলেন, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহের স্বপ্নের বিপরীতে তার উত্তরসুরীরা পাকিস্তানকে একটি মধ্যযুগীয় বর্বর ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করলেন।

চুরির অপরাধে হস্তকর্তন, বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্কের জন্য আকণ্ঠ মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা, একজন পুরুষ স্বাক্ষীর বিপরীতে দু’জন নারী স্বাক্ষী প্রদান করা, ইত্যাদি হুদুদ আইনের নামে এ সকল মধ্যযুগীয় আইন আজো পাকিস্তানে বিদ্যমান।

কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জিয়াউল হকের পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা শিক্ষায় প্রশিক্ষিত বেনজির ভূট্টো , ক্ষমতাসীন হলেও জিয়াউল হকের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে কোন সংস্কার পদক্ষেপ তিনি নিতে সাহস করেন নি।  পরবর্তী সময়ে  সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তালেবানদের উত্থান অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে মৌলবাদীরা আজ পাকিস্তানে শক্তিশালী।

 রীতিমত সরকারকে তারা চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। নিউেইয়র্ক টাইমস এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, আফগানিস্তানের সীমান্তসংলগ্ন একটি জেলায় বস্তুত তালেবানদের শাসন চলছে আর প্রশাসন সেখানে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে ।

দুঃখের বিষয় হল, স্বাধীনাতার প্রায় সাত দশক পরও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারল না। বরং নানা ধর্মীয় গোষ্ঠী, ধর্মীয় মতাদর্শের গেোঁড়ামীতে আক্রান্ত এমন একটি রাষ্ট্র, যা ক্রমান্বয়ে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। 

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ
ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের জাতিগত শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এর ফলশ্রুতিতে জন্ম আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের । সঙ্গত কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র আমাদের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে বাংলাদেশের সংবিধানে গৃহীত হয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় উপরোক্ত আদর্শ গুলোকে নীতিমালা হিসাবে গ্রহণ–একটি স্বল্প-শিক্ষিত, দারিদ্রক্লিষ্ট, জনগোষ্ঠির জন্য ছিল বাস্তবিকই অভাবনীয়, যা পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতির পর অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বল্প-শিক্ষিত ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী  এ অর্জনের তাৎপর্য  যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না।

তাই আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, স্বাধীনতার  পর, বঙ্গবন্ধু সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করেন। অথচ এই কুলাঙ্গার মোল্লা গুলোই  আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

রাজাকার-আলবদর বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে-তাদের নব্বই শতাংশের উপরে ছিল মাদ্রসার ছাত্র ও শিক্ষক। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু স্বয়ং মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের একাধিক সভা-সমাবেশে দুঃখের সাথে কথাটি উল্লেখ করলে তারা  সরকার ইসলামী ফাউণ্ডেশন সৃষ্টি করলেন।  যে ইসলামী ফাউন্ডেশন মৌলবাদীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল এবং এখনো সেই অপশক্তি বিদ্যমান। 

তারপরও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতিমালা হিসাবে বহাল ছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ অবারিত ছিল না।

 ১৯৭৫ ইং সালের আগষ্ট মাসে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যূত করে যারা ক্ষমতাসীন হল, তারা সর্বাগ্রে তাদের এ অপকর্মের বৈধতা দিতে জনগণের সামনে আবির্ভূত হলো ধর্মের আলখাল্লা পড়ে। এতবড় একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করতে  মাথায় কালোটুপি ও মুখে কথিত আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হল খুনী মোস্তাক ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলরা। ক্ষমতাসীন হয়েই যে তার পরিহিত কালো টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করেছিল যা ছিল একই সাথে অযৌক্তিক এবং হাস্যকর । 

এ প্রতিবিপ্লবের সুবিধাভোগী হিসাবে ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র মুছে দিলেন। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে নিয়ে আসলেন বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ,  অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে অধনবাদী বিকাশের পথ-যা সমকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলেতে সঠিক উন্নয়ন কৌশল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিল-তা পরিহার করে ধনবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করলেন।

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাত্তুরের যে সকল যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় ছিল তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হল। জামাতে ইসলামী সহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দল গুলোকে ধর্মের নামে নোংরা রাজনীতি করার লাইসেন্স ফিরিয়ে দিলেন জিয়াউর রহমান । 

জামাতের আমীর রাজাকার  গোলাম আজমকে দেশে এনে রাজনীতিতে পূনর্বাসিত করলেন। কতিপয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ-বিশেষভাবে সৌদী আরবের আর্থিক সাহায্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা তীব্রতর করল। যার মূল লক্ষ্য ছিলো বাঙলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল প্রমাণ করা এবং বাঙলাদেশকে তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করা।

পচাঁত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও আমজনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করল । মেজর জিয়া মতৌলবাদিদের খুশি করার জন্য তার  সকল বক্তব্য শুরু করার আগে প্রকাশ্যে "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা শুরু করলেন।

জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন খলনায়ক, তুলনাহীন দুশ্চরিত্র, লম্পট  হোসেন মোঃ এরশাদ, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন। লক্ষ্যে একই- তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিলেন । 

ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রের প্রবর্তন করে আরো একটি  নতুন মাত্রা যোগ করলেন । তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের কাছে যেতে শুরু করলেন এবং এসব গণ্ডমুর্খ,  ও ভণ্ড পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতে উৎসাহ বোধ করতেন।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে এরশাদ এমন এক হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, যখন তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তিনি প্রতি শুক্রবারে কোন না কোন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন এবং সেখানে গিয়ে তিনি পূর্বরাত্রে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছেন বলে ডাহা মিথ্যা অবলিলায় বলে যেতেন। অথচ মানুষ জানতো ও না যে  এরশাদ আসবেন বলে দু তিন দিন পূর্ব থেকেই সরকারী লোকেরা ঐ মসজিদ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিল।

এরশাদের পতনের পর,  প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসাবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারত বিরোধীতাকে কাজে লাগাল। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারে তারা জাতিকে বোঝালো যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলু ধ্বনি হবে-দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে- ইত্যাকার কথা জোরেশোরে বলে বেড়াতে লাগল ।

বলাবাহুল্য, তারা  সফলও হয়েছিল। তারা  নির্বাচনে জিতেছিল এবং ক্ষমতাসীন হয়ে তারাও রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচারানুষ্ঠানে-ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ষে বৃহৎ রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ-(বলা হয়ে থাকে) ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে-তারা ও তাদের রাজনৈতিক আচার আচরণেও ধার্মিকতা প্রদর্শণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। 

জয় বাঙলা শ্লোগানের সাথে তারা লা-ইলাহা ইল্লালাহু-নৌকার মালিক তুই আল্লাহ”- ইত্যাদি শ্লোগান উচ্চারণ করতে লাগল।

বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিএনপির সীমাহীন কারচুপির ঘটনা একটি দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্থায়ীরূপ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করল এবং  সে আন্দোলন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যুগপৎ কর্মসূচী গ্রহণ করল জামায়াতে ইসলামীর সাথে। যার ফলে ‍রাজনৈতিভাবে লাভবান হল জামাত।

আন্দোলনের মুখে প্রথমে বিএনপি একতরফা একটি নির্বাচন এবং  সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ এবং সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতার পটভূমিতে আবারো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হল। সুদীর্ঘদিন পর এবার ক্ষমতায় এলো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল  আওয়ামী লীগ।

কিন্তু বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আন্দোলন করতে গিয়ে জামায়াতের সাথে অঘোষিত ঐক্য করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কী ক্ষতিটা আওয়ামী লীগ করেছে তা বলাই বাহুল্য।  শুধু তাই  নয়, আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন আনল, যা প্রকারান্তরে ধর্মীয় রাজনীতিকেই উৎসাহিত করল।

দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূনর্বাসনের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগত গ্রহণ করল না। তারা তাদের দলীয় কর্মসূচী এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসুচীতে তারা ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করতে শুরু করল। সংসদে প্রত্যেক সাংসদদের মাথায় টুপি পরে বসা এবং যে কোন বক্তব্যের শুরুতেই জোর গলায়-বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহিম” বলা, কোন কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থ্পান করতে গিয়ে মোনাজাত করা, যে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলোয়াত করা, নেতা-নেত্রীর ফি বছর হজ্জ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণের সাথে রাজনৈতিক আচরণকে গুলিয়ে ফেলে অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের সাথে আওয়ামী লীগের আচরণের পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। যা এক অর্থে  ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বৈধতা প্রদান করছিল।

মজার ব্যাপার হল, ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপিতো নয়ই, আওয়ামী লীগও এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার কথা চিন্তাও করল না, এমনকি এখনো সাম্প্রতিক সময়ে ও যখন রাষ্ট্র ধর্ম বাতিলের কথা উঠল মৌলবাদীরা সব রকম চেষ্টা করল এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য। কেননা ধর্ম না থাকলে তারা তাদের ফায়দা লুটবে কী করে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে মহামান্য আদালত রাষ্ট্র ধর্ম বাতিলের পক্ষে রায় দেয় নি। 

ইতিহাসের একটি শিক্ষা হল- ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। রাজনৈতিক স্বার্থে-ক্ষমতার লোভে-যে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে নিজেদের সুবিধামত রাজনীতিতে ব্যবহার করছে, শেষ পর্যন্ত তারা কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারে নি এবং ভবিষ্যতে ও পারবে না।  বরং তাদের এ রাজনৈতিক আচরণ মৌলবাদীদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে দিবে।

পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা যেভাবে ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক  রাষ্ট্রে পরিণত করে এক টি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিনত করেছেন , কোনো এক অজানা কারনে  সে পথেই এগোচ্ছেন আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা । 

মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে আল্লাহের দুনিয়ায় আল্লাহের শাসন কায়েমের জিগির তুলে দেশের বিশেষভাবে গ্রামের দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বিপুল  সমর্থকগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পেরেছে। এজন্য তারা বিশেষভাবে টার্গেট করেছে গ্রামের মানুষদের। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের সুযোগে তারা তাদের তরুণ ছেলেদের সহজে প্রলুদ্ধ করতে পারছে,  নগর সভ্যতার বিকাশ ও পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার সীমাহীন দারিদ্র্য ও পশ্চাদপদতা, শহরের সাথে গ্রামের বৈষম্য, মৌলবাদী ধারণা প্রসারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরী করে রেখেছে।

মৌলবাদের মূল উৎস যেহেতু ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং এ গোঁড়ামীর উর্বরক্ষেত্র যেহেতু অশিক্ষা-কুশিক্ষা, সেহেতু তাকে রুখতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে হবে।বিশেষভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। 

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একই শিক্ষা পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে নয়তো নিষিদ্ধ করতে হবে ।  ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করতে হবে।  ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, নয়তো  একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচন, আইনের শাসন কায়েম, গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূরীকরণ-বিশেষভাবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন-ইত্যাদি আশু পদক্ষেপ মৌলবাদ উত্থানের বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। একটি পরিষ্কার বাগানে যেমন আগাছা জন্মাতে পারে না ,তেমনি একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক ও উন্নত আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে মৌলবাদসহ কোন প্রকার কুসংস্কারের আগাছা শিকড় গাড়তে পারবে না। 

তাই সত্যিই এদেশের মঙ্গল চাইলে মৌলবাদ কে কঠোর হাতে দমন করতে হবে, নয়তো এদেশের মানুষের মঙ্গল কখনোই সম্ভব না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url