নারীরাই নারীর অগ্রগতির প্রধান বাধা

বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান অবস্থা আগেকার সমাজব্যবস্থায় যে দুর্দশাগ্রস্ত ছিল তা অপেক্ষা অনেক উন্নতি সাধন করেছে। এখন নারীর-পুরুষ এক সাথে আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে এর পরেও নারীর ক্ষমতায়নের বাধা সমূহ এখনো পরিলক্ষিত হয়। সেই প্রাচীন কাল থেকেই নারীর সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য পুরুষ-কে দায়ী করলেও এর পিছনে নারীদের ও দায় একদমই নেই একথা কিন্তু সত্যি নয়। নারীরাই নারীর অগ্রগতির প্রধান বাধা একথা বিভিন্ন ভাবে আজও প্রমানিত হচ্ছে! 
নারীরাই নারীর অগ্রগতির প্রধান বাধা
সন্ধ্যার পর বাইরে যেতে চাও? তাও আবার একা?কী অলুক্ষনে কথা!জানো না ,মেয়ে মানুষের সন্ধ্যার পর একা বাইরে যেতে নেই। মানুষ কী বলবে! তুমি রান্না পারো না? ছি! ছি! তুমি কি মেয়ে মানুষ না অন্য কিছু? মেয়ে মানুষ বিয়ের পর চাকরি না করাই ভালো। চাকরি করলে সংসার দেখবে কে? চাকরি তো পুরুষ করবে। মেয়ে মানুষ হয়ে ওতো পুরুষের মাঝে ঢলাঢলি না করাই ভালো। 

এই কথা গুলো জীবনে একবারের জন্য হলেও শোনে নি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমরা যারা নারীদের অধিকার নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় গলা ফাটাই তারা কখনো কি একবার নিজেদের স্ব-গোত্রীয়দের দিক তাকিয়েছি? হয়তো না। যদি তাকাতাম তাহলে দেখতে পেতাম গন্ডগোল টা গোঁড়াতে। সরিষার মধ্যেই ভুত লুকিয়ে বসে আছে।


আজকে যখন আমরা কোনো নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষনের খবর পাই নারীবাদিদের  "পুরুষ ধর্ষক। পুরুষ জাতি, ধর্ষকের জাতি ", প্রভৃতি শ্লোগানে আশপাশ ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশ্ন হলো পুরুষ ধর্ষক বা নারীরা পুরুষের হাতে  নিগৃহীত হয় কেন? এর সহজ উত্তর হল এর জন্য দায়ী আমরা, আমরা নারীরা।  আমরা অনেকেই মনে করি থাকি নারীর অগ্রগতি বা নারীর এগিয়ে চলার পথে প্রধান অন্তরায় হল পুরুষ কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে নারীর এগিয়ে চলার প্রধান অন্তরায় নারী নিজেই।

নারী পুরুষের সমগোত্রীয় বন্ধুত্ব সম্পর্কে জার্মান দার্শনিক " শোপেনহাওয়ার" বলেছিলেন," (১৮৫১)  ‘the feeling between male strangers or acquaintances was ‘mere indifference’; for women it was ‘actual enmity. অর্থাৎ নারীর প্রতি নারীর যে ঈর্ষা তা জার্মান দার্শনিকদের ও চোখ এড়ায় নি।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় নারীর অগ্রগতিতে প্রধান বাঁধা নারী নিজেই। এই আলোচনার পূর্বে চলুন দেখে নেই বর্তমান অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা কতখানি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯ লক্ষ ২ হাজার ৪৮২ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গিয়েছেন। ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী কৃষি ক্ষেত্রে, ৪০ লাখ ৯০ হাজার নারী শিল্প ক্ষেত্রে এবং ৩৭ লাখ নারী সেবা খাত কাজ করছে। যার জিডিপি হিসাব করলে দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। নারীর কাজের মাত্র ১৩-২২ শতাংশ জিডিপি হিসাব করা হয়। বাকী ৭৭- ৭৮ শতাংশ হিসেবের বাইরেই থেকে যায়। এই রেশিও থেকে একটা ব্যাপার আমরা খুব সহজেই অনুমান করতে পারি যে দেশের অর্থনীতিতে নারী একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে।

কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি শাখায় এত সাফল্য থাকা স্বত্বেও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা,  ধর্মীয় কুসংস্কার প্রভৃতি নানা কারনে নারীদের বার বার বাধা সম্মুখীন হতে হয়েছে কখনো পুরুষ দ্বারা কখনো অন্য নারীর দ্বারা। 

" ছেলেকে অনেক পড়াশোনা শেখাবো। চাকরী করতে হবে তো! আর মেয়ে? মেয়ে মানুষ কম পড়াশোনাই ভালো। ওতো পড়াশোনা করে কী লাভ?সেই তো চুলাই ঠেলতে হবে। বেশী পড়ালে মেয়ে জন্য ভালো বর পাওয়া না যায় । তখন এই ঝামেলা সামলাবে কে? সংসারের কাজ কর্ম এখনো না শিখলে বিয়ের পর সংসার চালাবি কি করে" বাঙালি বেশির ভাগ পরিবারে একটি একটি সাধারন চিত্র । একজন মা তার সন্তানের প্রধান শক্তি। সেই মা ই যদি এমন ধারনা পোষন করেন তাহলে কি আমরা এই কথাটা বলতে পারি না যে একজন নারীর এগিয়ে চলার পথে প্রধান অন্তরায় পুরুষ নয়, নারী নিজেই। একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে," Women is the enemy to herself" বর্তমান সমাজের দিক তাকালে বাক্যটির মর্ম হারে হারে টের পাওয়া যায়। 

"আমি একটা মেয়ে হয়ে এই কাজটা কেনো  করবো? এত কঠিন কাজ করার জন্য আমি কেন? এটা তো ছেলেরা করবে।আমি একটা মেয়ে হয়ে এত রাত পর্যন্ত কাজ কেন করব?", এই অজুহাত গুলো কিন্তু আমরা মেয়েরাই তৈরী করে নেই। আমরা সমাজে সমান অধিকার ও চাইবো আবার কাজের বেলায় পিছিয়েও থাকবো তাহলে তো " বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার " ব্যাপারটার মত হয়ে গেল। একটি পরিবারের নারী সদস্যরা মনে করেন মেয়েদের জন্মই শুধু ঘর সামলানোর জন্য, ধর্মকর্ম করার জন্য , আর বাচ্চা উৎপাদনের জন্য। কোনো মেয়ে যদি বিয়ের পর ঘরের কাজে কোনো অপারগতা প্রকাশ করে কিংবা বিয়ের পর চাকুরি করতে চায় তাহলে সে যেন কোনো মানুষ খুনের মত অপরাধ করে ফেললো। তখন তার উপর নেমে আসে ননদ, শাশুড়ির অকথ্য নির্যাতন। 

আবার যখন সমাজে বা কর্মক্ষেত্রে কোনো নারী সাফল্য লাভ করে তখন সেটা অন্য নারীদের গাত্রদাহের কারন হয়ে দাঁড়ায়। " নিশ্চয়ই বসের সাথে কোনো চক্কর ছিল তাই প্রমোশনটা পেয়েছে। আমি তো এসব পারি না তাই পিছিয়ে আছি" । আবার নারীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য নিজেই নিজের সাপোর্ট হওয়ার চেয়ে পুরুষের প্রতি নির্ভর করতে বেশী ভালোবাসে। 

অর্থাৎ মূল সমস্যা হল নারী নিজেই নিজেকে একটা বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখে।নতুন করে কিছু ভাবতে নারী এখনো শেখে নি। ।নারীরা পুরুষের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে যতদিন না নিজের প্রতি নির্ভর হতে পারছে ততদিন পর্যন্ত নারী মুক্তি কখনই সম্ভব না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url