একটি কলমের আত্মকাহিনী

একটি কলমের আত্মকাহিনী
একটি কলমের আত্মকথা
আত্মকথা মূলক রচনা
আত্মকথা রচনা
আত্মকথা
মনুষ্যজাতি বড় স্বার্থপর! তারা তাদের নিজেদের কে নিয়েই মহাব্যস্ত। অথচ তাদের আশপাশে তাদেরই প্রয়ােজনে নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে যাচ্ছে কত না ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব ও জড় পদার্থ। তাদের কোনাে খেজই তারা রাখে না। বিষয়টি নিয়ে আমার খুবই দুঃখ হয়। আর সেই দুঃখ ও বিরহ নিয়েই আজ জড় পদার্থসহয়েও লিখতে বসলাম নিজের জীবনের কথা, মানুষ যাকে বলে আত্মজীবনী বা আত্মকাহিনী । আমি একটি কলম। আমার নাম ‘পাইলট'। জন্মটা এক কালের সুবিখ্যাত পাইলট কোম্পানিতে। উন্নত প্রযুক্তি আর আধুনিকায়নের স্রোতে আমার সেই জন্মদাতার আজ অনেক বছর যাবৎ কোনাে খোঁজখবর পাই না। অনেক জাতি ভাইকে জিজ্ঞেস করেও তার কোনাে হদিস পাইনি। মনের দুঃখে অনেক দিন হলাে তারও আর কোনাে খোঁজ করিনি। কারণ, খোঁজ করেই বা কি হবে! যেখানে আমার জীবন নিয়েই আমি এখন মহা সংকটে আছি, সেখানে অন্যের খােজ নেই কী করে!

হ্যা! আমার জীবন নিয়েই আমি এখন খুব সংকটে আছি। আর আমার এ সংকটটি সৃষ্টি করেছে আমারই মালিক আঁখি। অবশ্য তিনি আমার প্রকৃত মালিক ছিলেন না। তিনি আমাকে পেয়ে ছিলেন উপহার হিসেবে। আমার জন্মের পর আমি প্রথমে এক জাকজমকপূর্ণ শো-রুমে আনীত হই। সেখানে সােনালি রঙের পিতলের বক্সে লাল টকটকে একটা উলের কাপড়ের আবরণের মধ্যে আমাকে রাখা হয়। আমাকে দেখার জন্য প্রতিদিন অনেক লােক আসত, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করত, দামাদামি করত। অনেকে কিনতে পারত না বলে খুবই দুঃখ করত। এক বার তাে এক ছেলে তার বাবার কাছে বায়না ধরে বসল, আমাকে তার চাই-ই। কিন্তু বুঝলাম যে, তার বাবা খুব হিসেবি লােক।

অতটুকু ছেলের হাতে দুইশ টাকা দিয়ে আমাকে কিনে কী লাভ- সে প্রশ্নই তার কাছে মুখ্য হলাে। আমার সৌন্দর্য ছেলেটার উৎসাহ বা আমার প্রয়ােজনীয়তা এর কোনােটাই তাকে ভাবাল না। ছেলেটা অনেক কান্না করে শেষে বাবার ধমক খেয়ে বিদায় হলাে।

আমার খুব মায়া হলাে ওর জন্য। কারণ আমার রূপে সত্যি ও মুগ্ধ হয়েছিল এবং একবার দেখেই আমাকে ভালােবেসে ছিল। আর কারাে হৃদয় ছোঁয়ার যে কী মূল্য সে আমি বুঝি। কারণ আমার পরবর্তী মালিক আমাকে তা প্রতিনিয়তই বােঝাতেন। আমার পরবর্তী মালিকের নাম প্রমােদ শাহ্। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন তিনি আমাকে নিউমার্কেটের সেই জাঁকজমক পূর্ণ দোকান থেকে কিনে আনলেন। তিনি থাকতেন কবি জসীমউদ্দীন হলের ৪৩২ নম্বর রুমে। পড়ালেখার জন্য তিনি ব্যবহার করতেন বিভিন্ন কলম। আর আমাকে অত্যন্ত আদর করতেন বলে আমার দ্বারা লিখতেন হৃদয়ের নিভৃতের কথাগুলাে। লিখতেন কবিতা আকারে তার বন্ধু - বান্ধবী অথবা বাবা-মার কাছে। তার হৃদয়ের ভাব প্রকাশের সহযােগী হতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত ভাবতাম আমি। একবার অনেক রাতে তিনি আমাকে হাতে তুলে নিলেন অত্যন্ত বিষন্ন মনে। বেচারার বেদনার্ত মুখ দেখে আমার ঠোটও ভারি হয়েছিল সেদিন। শেষে যখন বিষয়টা অনুভব করতে পারলাম, তখন আমিও ঝরঝর করে কালাে অশ্রু দিয়ে ভরিয়ে তুললাম তার খাতার পাতা। তিনি লিখেছেন,

“আব্বু!
আজ ৩১ ডিসেম্বর
তুমি চলে গেলে
পড়ে রইলেম আমি
অবহেলায়-
বড় নিঃসঙ্গতায় ...।”

-বুঝলাম এই ৩১ শে ডিসেম্বরে তার বাবা মারা গিয়েছেন। আর তারই জন্য আজ কিছু একটা লিখতে বসে কেঁদে ফেললেন তিনি। এভাবে তার অনেক বিষাদের ঘটনার সাক্ষী আমি। আবার অনেক সুখের অনুভূতির ছোঁয়াও তিনি আমাকে দিয়েই নিয়েছেন। দ্বিতীয় বর্ষে পা দেওয়ার পরপরই তিনি আঁখি নামক তার এক বান্ধবীকে প্রায়ই চিঠি লিখতেন। বড় মধুর সে চিঠি। লিখতে গিয়ে আমার আনন্দের কোনাে সীমা থাকত না। একবার তিনি লিখলেন,

“কবিতা!
আমি তােমাকেই চাই
বসন্ত সমীরণ
আজীবন-আমরণ।
শুনিতে সানাই
আমি তােমাকেই চাই।”

এভাবেই চলছিল দিন এবং চলতে পারত আরাে। কিন্তু তা আর হলাে না! মানুষের মন তাে! কখন কী পরিবর্তন হয় বলা কঠিন। একদিন তিনি সেই সুসজ্জিত বক্সে উঠিয়ে তা অন্য একটি রঙিন পেপারে মুড়িয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন তার সেই বান্ধবীর ঠিকানায়। আমি সেখানে বেশ আদর-যত্নেই আনীত হলাম। তারপর আঁখিমণি আমাকে মােড়ক থেকে উদ্ধার করে হাতে নিলেন এবং খুশিতে নেচে উঠলেন। তার খুশি দেখে আমারও বেশ আনন্দ হলাে। কিন্তু বেশিদিন তা রইল না। তিনি অনেক দিন অযত্ন-অবহেলায় আমাকে ড্রয়ারে ফেলে রাখলেন। আমাকে দিয়ে তিনি কোনাে কাজই করালেন না। আর কর্মহীন জীবন যে কোনাে জীবন নয় তা তাে সবাই জানে। আমি আস্তে আস্তে অকর্মণ্য ও ধূলিমলিন হয়ে পড়লাম। এরই মাঝে আঁখিমণির এক বান্ধবী একদিন আমাকে চেয়ে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তার হাত থেকে আমি পথের মাঝে পড়ে যাই। মুহূর্তের মধ্যে আমার বুকের ওপর দিয়ে চলে যায় এক যন্ত্রদানব, ট্রাক যার নাম। আমার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পরদিন সকাল পর্যন্ত মুমূর্ষ অবস্থায় আমি সেখানেই পড়ে থাকি। সকাল হওয়ার সাথে সাথেই এক ঝাড়ুদার ঝাড়ু দিয়ে আমাকে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসে ডাস্টবিনে।

তখন থেকে এখানে পড়েই কাঁদছি আর ভাবছি মানুষের স্বার্থপরতার কথা। প্রমােদ শাহ আমাকে ভালােবাসতেন। আমিও তাকে অত্যন্ত ভালােবাসতাম। কিন্তু তিনি আমার কথা একটুও না ভেবে পাঠিয়ে দিলেন তার এক বান্ধবীর কাছে; যে কি না এক অকর্মা দায়িত্ব হীনা মেয়ে। তার অবহেলার জন্যই তাে আজ আমার এ করুণ দশা! বলুন তাে! এমন হলে কার না দুঃখ হয় । অতীতের সেই সুখময় দিনগুলাের কথা মনে হলে বড়ই খারাপ লাগে। আর তখনই অভিমান জাগে প্রমােদ সাহেবের ওপর। তবু বলি উনি সুখী হােক। আমি তার মঙ্গল চাই। কারণ আমি তাকে ভালােবাসি ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url