বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দীর্ঘ ২৪ বছরে পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণের মধ্যে যে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্ম হয়েছিল মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সাবলীল ভঙিমায় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। শুধু অভিযােগ ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তিনি ক্ষান্ত হননি, একই সঙ্গে আপামর বাঙালির মুক্তির পথও বাতলিয়েছেন তিনি তাঁর ভাষণে। এ জন্য এ ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধু তার পাণ্ডিত্য ও তেজোদীপ্তময় ঘােষণার
মধ্য দিয়ে এদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাও দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
৭ই মার্চের ভাষন
নিম্নে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব তুলে ধরা হলাে :
১:ইতিহাসের অনন্য দলিল :
শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয় বিশ্বের ইতিহাসে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ এক অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।একজন নেতার একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ একটি পুরাে জাতিকে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ ও আমরণ সংগ্রামে উদ্বেলিত করতে পারে তার অনন্য নজির হয়ে আছে এই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ । সেদিন বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী বক্তৃতা লাখ লাখ মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এরূপ একটি ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল।
২. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ :
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলাের
একটি। এ ভাষণকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গ্যাটিসবার্গ বক্তৃতা ও মাটিন লুথার কিং এর আই হ্যাভ এ ড্রিম (১৯৬৩) বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। ১৮৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতিকে একতাবদ্ধ করার জন্য গ্যটিসবার্গে মাত্র ৩ মিনিটের এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন যা ইতিহাসে অত্যন্ত খ্যাতি লাভ করে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ গ্যাটিসবার্গ ভাষণের মতােই ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।
৩, শােষণ বঞ্চনার ইতিহাস :
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল
ভাষায় ২৩ বছরের শােষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন। কিভাবে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী বাঙালিদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করেছিল এ ভাষণ ছিল তার সংক্ষিপ্ত আলেখ্য। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান পর্বতসম বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তার সমাধানের দাবি করেন।
৪. বাঙালির মুক্তির দলিল :
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ থেকে ছিন্ন হয়ে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাঙালিরা সেদিন ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু বাঙালিরা সেদিন আরেকটি ঔপনিবেশিক শক্তির
শােষণের যাতাকলে পড়ে। এদেশের মানুষ বার বার তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বঞ্চনা, বৈষম্য আর অত্যাচার নিপীড়ন থেকে বাচার জন্য এদেশের মানুষ।বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালিদের সে মুক্তি ও বাচার কথা ঘােষণা করা হয়। তিনি বলেন, আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়'। এ ভাষণের পর বাঙালির এতােদিনের মুক্তির আকাঙ্খ যেন পূর্ণতা পায় । মানুষ সেদিন বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে অসহযােগ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল ।
৫. বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোেধ সৃষ্টি :
৭ কোটি বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবােধ সৃষ্টিতে ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর বাণী ছিল।মন্ত্রমুগ্ধের মতাে। তিনি যেমন তার ভাষণে ভায়েরা আমার বলে সম্বােধন করেছিলেন তেমনি বাঙালিদেরকেও পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সেদিন বাঙালি জাতির মধ্যে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ববােধের সৃষ্টি করে।
৬. জাতিকে সুসংগঠিতকরণ :
একটি সুসংগঠিত জাতি ছাড়া কোন আন্দোলন সংগ্রাম সফল হয় না। আন্দোলন সংগ্রামের প্রাণ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে একতাবদ্ধ করাই হচ্ছে নেতার অন্যতম কাজ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সে কাজটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার মন্ত্রমুগ্ধময় ভাষণে পুরাে জাতি এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। মুলত সেদিনের ভাষণই বাঙালিদের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে সাহস যুগিয়েছিল ।
৭, স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধকরণ :
৭ মার্চের ভাষণ এদেশের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি তাঁর ভাষণে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে প্রেরণা পেয়ে সেদিন বাঙালি জাতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল, রক্ত দিয়ে হলেও এদেশকে স্বাধীন করবে ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
৮, স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা :
ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কর্মকাণ্ড দেখে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। সংগ্রাম করেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য তিনি তার ভাষণে অত্যন্ত
দক্ষতার সাথে স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি পাড়া মহল্লায় সংগ্রাম গড়ে তােলার আহবান জানান । যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার কথা বলেন।ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােলার কথা বলেন। এভাবে তিনি মূলত একটি গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা প্রদান করেন।
৯, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরােক্ষ ঘােষণা :
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে পরােক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘােষণা দেয়া হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত কৌশলী ও নিপুণতার সাথে স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন। তিনি তার ভাষণের শেষ লাইনে বলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। জয় বাংলা।' এরূপ বক্তব্যের পর স্বাধীনতার ঘােষণার আর প্রয়ােজন পড়ে না। তবে বঙ্গবন্ধুর এ ঘােষণায়
এমন এক কৌশল ছিল যাতে স্বাধীনতার ঘােষণার কিছু বাকিও থাকল না আবার তার বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার অভিযােগ উত্থাপন করাও সম্ভব ছিল না।
১০. আসম্প্রদায়িক চেতনার সৃষ্টি :
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক নেতা। তিনি ধর্ম মত নির্বিশেষে বাঙালির মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ সকলকে ভাই ভাই উল্লেখ করে প্রয়ােজনীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার উপর গুরুত্বারােপ করেন।এভাবে দেখা যায়, ৭ মার্চের ভাষণ এ দেশের লক্ষ লক্ষ লােককে একা দাঁড়িয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

দেখা যায়, ৭ মার্চের ভাষণের পর পর সত্যি সত্যি স্বাধীনতা সংগ্রামের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী তার নিয়ন্ত্রণ পরে হারিয়ে ফেলে। পুরাে দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। এ ভাষন
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলাে ভাষণের প্রতিটি নির্দেশনা এ দেশের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বস্তুত ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণকে সামনে রেখেই দীর্ঘ নয় মাস এ দেশের মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দেয়।
Next Post Previous Post