বাংলা রচনা: বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন বা, প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যুৎ

রচনা:বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের অবদান।অথবা,দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার।
রচনা বিদ্যুৎ
রচনা:বিদ্যুৎ

ভূমিকা : আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানুষ আজ জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে, মর্ত্যে-মহাকাশে সূত্র দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজ করছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানুষ নজরুলের সেই বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে” কথাটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।মানুষ এখন ঘরে বসে মুহুর্তের মধ্যে সারা বিশ্বের সব খবর নিতে পারে। বিজ্ঞানের আর্শীবাদে মানুষ আজ দীর্ঘজীবী হয়েছে, প্রায় সব ধরনের অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছে। বিজ্ঞানের এ আশ্চর্য সাফল্যের সূত্রপাত হয় যে আবিষ্কারটির মাধ্যমে সেটি হচ্ছে বিদ্যুৎ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিজ্ঞানের যত অবদান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে বিদ্যুতের আবিষ্কার। কারণ বিজ্ঞানের অন্যান্য যে আবিষ্কার তা হয়েছে কোনাে না কোনােভাবে বিদ্যুতের সহযােগিতার মাধ্যমে। আর বর্তমান মানব সভ্যতার কথা তাে বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। বিদ্যৎ হচ্ছে বর্তমান সভ্যতার জীবন প্রদীপ, যা ছাড়া মানুষ আর এক মুহূর্তও চলতে পারে না।

বিদ্যুতের আবিষ্কার ও তার পূর্বাপর অবস্থা : বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পূর্বে মানবসভ্যতা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। তখন মানুষের জীবনে ছিল না সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিশীলতা। কৃষিকাজ তখন মানুষের জীবিকার প্রধান উপায় হলেও কৃষির পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। আর বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর মানবসভ্যতায় এসেছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিদ্যুতভিত্তিক নিত্য-নতুন উদ্ভাবনে মানবজীবনে এসেছে গতিশীলতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বিদ্যুতের বিচিত্র ব্যবহার মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে বয়ে এনেছে সীমাহীন সমৃদ্ধি। মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে মিল কারখানা ও যােগাযােগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ছাড়া আজ আর কোনােকিছুই কল্পনা করা যায় না। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতাে বিদ্যুতের আবিষ্কার ও ব্যবহার মানুষের জীবন ও সভ্যতাকে পুরােপুরি বদলে দিয়েছে। যিনি এ আশ্চর্য প্রদীপরূপী বিদ্যুতের আবিষ্কারক তার নাম মাইকেল ফ্যারাডে। ১৮৩১ সালে তিনি বিদ্যুতের আবিষ্কার করেন।

বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের অবদান ; আমরা বর্তমান প্রজন্মের মানুষ। 'কল টিপিলেই জল পাই’- এ হচ্ছে আমাদের অবস্থা। আমরা সুইচ টিপলেই বাতি জলে, অন্ধকার দূরীভূত হয়; পাখা ঘােরে, এসি চলে, আমরা আরাম-আয়েশে থাকতে পারি। সুইচ টিপলেই টিভি চলে,কম্পিউটার চলে, আমরা খেলা দেখি, গান-বাজনা শুনি, সিনেমা দেখি- আরাে কত রকম কাজকর্ম করি তার হিসেব নেই। কিন্তু সভ্যতার এ যে অভাবনীয় উন্নতি এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কার, সেটি এখন আমাদের কে আর ততটা ভাবায় না। যদি একবার ভাবি যে, বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পূর্বে জগতটা কেমন ছিল বা টানা দুদিন বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের কী অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাহলেই আমরা বর্তমান।সভ্যতায় বিদ্যুতের গুরুত্ব বা অবদান অনুভব করতে পারব। বলা যায় যে, বর্তমান সভ্যতা পুরােপুরিই বিদ্যুৎশক্তির ওপর নির্ভরশীল।
মানবদেহে রক্ত সঞলনের জন্য যেমন শিরা-উপশিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তেমনই সভ্যতার উন্নতি অগ্রগতির জন্য বিদ্যুতের তার।সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে। একটু বিচ্যুতি ঘটলেই প্রায় সবকিছুই বিকল হয়ে যায়। তাই বলা যায় যে, বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের কোনাে বিকল্প নেই। বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের অবদানের কিছু কিছু ক্ষেত্র নিচে ধারাবাহিক ভাবে আলােচনা করা হলাে :

দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যতের অবদান : বিদ্যুতের ব্যবহার মানুষের জীবনধারাকে পুরােপুরি বদলে দিয়েছে। বিদ্যুতের ব্যবহারে মানুষের নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রী অত্যন্ত সহজলভ্য হয়েছে। কৃষকবধূ ঢেকিতে যে ধান তিন দিনে ভানত, বিদ্যতের অবদানে এখন তা তিন ঘণ্টায় ভানা যায় হাতপাখা ঘুরাতে ঘুরাতে যেখানে গরমের দিনে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত, এখন সেখানে এসেছে বৈদ্যুতিক পাখা। যারা সম্পদশালী স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে তৈরি করা হয়েছে এয়ারকুলার বা এসি।আর সেটিও চলে বিদ্যুতে। রান্না-বান্না,কাপড় ইসি করা খাবার টাটকা রাখার জন্য ফ্রিজের ব্যবহার, বিনােদনের জন্য রেডিও, টেলিভিশন কমিপউটার ব্যবহার।যােগাযােগের জন্য টেলিফোন, ইন্টারনেট, ই-মেইল ইত্যাদি সবই চলে বিদ্যুতে। এক কথায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এমন কোনাে ক্ষেত্র নেই, যেখানে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে না বা যেখানে বিদ্যুৎ ছাড়া চলে।

গবেষণা, শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে বিদ্যুৎ : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে নানাভাবে নানা কাজে বিদ্যুৎ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান সভ্যতা কম্পিউটার ছাড়া কোনাে কাজই করা সম্ভব হয় না। চিকিৎসা, গবেষণা বা স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র সব কার্যক্রম চলে কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণে । অথচ এ কম্পিউটার বিদ্যুৎ ছাড়া চলে না। তার মানে দাঁড়ায় যে,বিদ্যুৎ ছাড়া এসব কাজও অচল প্রায়।

কৃষি ও শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ : বিভিন্ন দেশে শিল্প বিপ্লবের যে ধারা সেটিও সম্ভব হয়েছে বিদ্যুতের অবদানে। যে কাজটি করতে আগে হাজার মানুষের হাজার দিন লাগত, সেই একই কাজটি এখন কয়েক জন মানুষ যন্ত্রের সাহায্যে কয়েক দিন বা কয়েক ঘণ্টায় সমাপ্ত করতে পারে। শিল্প সভ্যতার এ গতিশীলতার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ না হলে এখন আর কোনাে কল-কারখানাই চলে না। বিদ্যুৎ আবিষ্কার ও ব্যবহারের ফলে যেমন দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে এবং উৎপাদন যেমন তরান্বিত হয়েছে শিল্পক্ষেত্রে, তেমনই সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছে কৃষিক্ষেত্রে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে বিদ্যুৎচালিত পাম্প-সেচ পদ্ধতি। ফসল উৎপাদন, বীজ বপন, চারা রােপণ, ফসল সংগ্রহ, ফসল মাড়াইসহ প্রায় সব ধরনের কৃষিকাজে এখন বিদ্যুৎশক্তি নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক কথায় বিদ্যুতের ব্যবহারেই কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে বর্তমানের এ অভূতপূর্ব উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

যােগাযােগ ব্যবস্থা ও অফিস-আদালতে বিদ্যুৎ : যােগাযােগ ব্যবস্থা এখন প্রায় পুরােপুরিই বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রিত। উন্নত বিশ্বে বর্তমানে বিদ্যুতের সাহায্যে যানবাহন চালানাে হচ্ছে। বৈদ্যুতিক ট্রেন, ট্রাম এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাছাড়া যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে যে মিডিয়াগুলাে রয়েছে।যেমন ; ই-মেইল, ইন্টারনেট, ফোন-ফ্যাক্স ইত্যাদি সবই চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। তাছাড়া অফিস-আদালতের প্রায় প্রতিটি কাজেই কোনাে কোনাে ভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে।

বিনিয়ােগ ও কর্মসংস্থান : বর্তমান বিশ্বের যে কোনাে দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ। কারণ বিদ্যুৎ না থাকলে সব ধরনের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায় । বিদ্যুতের গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং লাভের দিকটি লক্ষ করে এ খাতে এখন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর টাকা বিনিয়ােগ করা হচ্ছে। কারণ এ খাতে কোনাে লস নেই বা বিদ্যুতের কোনাে বিকল্পও নেই। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনেক লােক
কাজ করে। এতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।শিক্ষিত ও শ্রমনির্ভর মানুষের কর্মসংস্থানের একটি উল্লেখ যােগ্য খাত বিদ্যুৎ।

উপসংহার : বর্তমান সভ্যতা সম্পূর্ণরুপে বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়,আমাদের প্রায় সব কার্যক্রম থেমে যায়, একেবারে থমকে দাড়ায় নাগরিক জীবন । উন্নত বিশ্বে এক মিনিট বিদ্যুৎ না থাকলে ক্ষতি হয়ে যায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। অনেক সময় হাসপাতালের কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়ে অনিষ্ট ঘটে জীবনের। অর্থাৎ জীবন-মৃত্যর প্রশ্নটিও যেন জড়িয়ে যায় বিদ্যুতের সাথে। কাজেই বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের অবদান নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url