ইতিহাসের স্বরূপ বা প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য Nature or Characteristics of History

ইতিহাস মানবজাতির অতীত কর্মের খতিয়ান বা দলিল। সময়ের নীরব সাক্ষী হিসেবে ইতিহাস একটি নির্দিষ্ট সময়ের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণের কালানুক্রমিক চিত্র। জগতে প্রত্যেকটি বিষয় বা বস্তুর যেমন প্রকৃতি থাকে তেমনি শাস্ত্র হিসেবে ইতিহাসও কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক কলিংউড (Collingwood) তার 'The Idea of History (1962:18)' তে বলেন, “ইতিহাস হচ্ছে এক ধরনের গবেষণা বা অনুসন্ধান (A kind of search or inquiry)।” তাঁর মতে ইতিহাসের উদ্দেশ্য বা কাজ হলাে মানুষের অতীত ক্রিয়া-কর্মের অনুসন্ধান। এটি মানুষের অতীত কর্ম সম্পর্কে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে প্রয়াস পায়। ইতিহাস কেমন তা তার বর্ণনায় এগিয়ে চলে এ প্রশ্নে তিনি বলেন যে, "History is for human self-knowledge." অর্থাৎ, নিজেকে জানা প্রয়ােজন। তিনি আরাে বলেন, মানুষ হিসেবে তােমার প্রকৃত পরিচয় কি, অন্য মানুষ থেকে তােমার পৃথক বৈশিষ্ট্য হেতু কি এবং কেনই বা তােমার মতাে আর কেউ নয়।ইত্যাকার বিষয় জানাই ইতিহাস পাঠের লক্ষ্য। তিনি ইতিহাসের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন।
ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য

১. ইতিহাস বিজ্ঞানভিত্তিক (Scientific)। কেননা এটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে যাত্রা শুরু করে।
২. ইতিহাস মানবিক (Humanistic)। কেননা এটি মানব কর্তৃক সংঘটিত ঘটনা বা মানব কর্তৃক সমাপ্ত কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে।
৩, ইতিহাস যুক্তিশীল (Rational)। কেননা এটি যুক্তিপ্রমাণের উপর নির্ভরশীল এবং
৪. ইতিহাস প্রকাশিত (Self revelatory)। কেননা মানব প্রকৃতি কেমন বা।

মানুষ যে কি তা বলতে গিয়ে এটি মানুষ কি করেছে তা ব্যাখ্যা করে।এছাড়া ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন লেখনী পর্যালােচনা করে যে সকল বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় সেগুলােকে নিম্নভাবে দেখানাে যেতে পারে :

১. উৎস ও তথ্যভিত্তিক : ইতিহাসের উৎস ও তথ্যসূত্র থাকা চাই। কারণ ইতিহাস শুধু কারাে মনগড়া হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা নয়। বরং এটি যথাযথ তথ্য ও সূত্র কর্তৃক সমর্থিত একটি বর্ণনার সমাহার। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন
চুক্তি, ঘটনার তথ্যসহ বর্ণনায় এ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
২. অনুসন্ধানমূলক : ইতিহাস অনুসন্ধানের বিজ্ঞান। মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত কর্মের উপর অনুসন্ধান করে এটি প্রয়ােজনীয় তথ্যসংগ্রহ ও সম্পাদন করে থাকে।
ঘটনার পিছনের ঘটনাটি জানা এবং ঘটনার পিছনে কিভাবে অন্য ঘটনাটির প্রভাব বর্তমান তারও যুক্তিসংগত অনুসন্ধান করে থাকে। উৎপত্তিগত দিক থেকেও এটি সমর্থনযােগ্য। History শব্দটি এসেছে Historia থেকে যার অর্থ (An inquiry designed to elicit truth)
৩, আত্মােপলব্ধিমূলক : ইতিহাস যেমন একদিকে অতীত ঘটনার বর্ণনা তেমনি তার বিশ্লেষণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে যাচাই বাছাইয়ের প্রয়ােজন রয়েছে। তেমনি এটি
আমাদের অতীত ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের নিজের অবস্থান বা আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করে থাকে।
৪. সর্বজনীনতা : ইতিহাস কোন বিশেষ গােষ্ঠী বা শ্রেণির শাস্ত্র নয় বা তাদের কর্মের প্রতিফলক নয়। বরং একজন ঐতিহাসিক একটি ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ
থেকে এবং সকল শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে বর্ণনা করেন। অর্থাৎ এটি রচনার ক্ষেত্রে একজন ঐতিহাসিককে একদিকে যেমন সময়কে বিবেচনায় রাখতে হয় তেমনি তাকে সকল শ্রেণির প্রতিনিধিত্বের দিকটিরও খেয়াল রাখতে হয়।
৫. অতীতকে তুলে ধরা : ইতিহাস মানবজাতির অতীতের দর্পণ স্বরূপ।প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস জীবন্ত অতীত হিসেবে অতীতের যাবতীয় কার্যক্রম ও ঘটনা
আমাদের কাছে তুলে ধরে।
৬, নিরপেক্ষতা : নিরপেক্ষতা ছাড়া বিজ্ঞান কল্পনা করা যায় না। ইতিহাসকে গ্রহণযােগ্য ও বিজ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একে অবশ্যই নিরপেক্ষতা অবলম্বন
করতে হবে। ইতিহাস মূলত অতীত ঘটনার নিরপেক্ষ ও বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনা।
৭, ধারাবাহিকতা : ধারাবাহিকতা ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অতীতের ঘটনার ধারাবাহিক ও কালানুক্রমিক বর্ণনা ইতিহাস। অর্থাৎ ইতিহাস অতীত ঘটনার এলােমেলাে বর্ণনার পরিবর্তে সহজ ও সময়ানুক্রমিক বর্ণনা দিয়ে থাকে।
৮, মানবীয়তা : ইতিহাসের উৎস যেহেতু মানবকর্ম। তাই ঘটনাগুলাের বর্ণনাও মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও লিপিবদ্ধ
করা হয়ে থাকে।
৯, সময়ানুক্রমিকতা : ধারাবাহিকতার মতই সময়ানুক্রমিকতাও ইতিহাসের অপর একটি তাৎপর্যময় বৈশিষ্ট্য। যার ইতিহাসের পাতায় যত ঘটনা ও কর্মকাণ্ড স্থান পেয়েছে সেগুলাে নিশ্চিতভাবেই কোন সন-তারিখে সম্পন্ন ও সংঘটিত হয়েছে এবং এগুলাে ইতিহাসের পাতায় সময়ানুক্রমিকভাবেই লিপিবদ্ধ করতে হয়।
১০, সঠিকত্ব : ইতিহাসে সঠিক ও যাচাইকৃত তথ্য লিপিবদ্ধ করতে হয়, তা না।হলে সেটি ইতিহাস না হয়ে কল্পনার কোন সাহিত্য হবে। তাই সঠিক ইতিহাসের
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
১১. প্রাচীনত্ব ; সময়ের পরিক্রমায় কোন ঘটনা গতকাল থেকে গত পরশু, গত সপ্তাহ থেকে গত মাস বছর পেরিয়ে শতাব্দী এবং তদাপেক্ষা প্রাচীন হয়ে যায় কিন্তু ঘটনা যত প্রাচীনই হােক না কেন তা ইতিহাসের আওতার বাইরে যেতে পারে না। তাই প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১২. অবিচ্ছিন্নতা : ইতিহাস কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে ও পরের ঘটনার সাথে লিপিবদ্ধকৃত ঘটনার যােগসূত্র থাকে। তবে পাঠের সুবিধার্থে ইতিহাসকে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ বলে বিভক্ত করা হয়। তাই অবিচ্ছিন্নতা ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১৩, পরিবর্তনশীলতা : সমাজ যেহেতু পরিবর্তনশীল। আর ব্যক্তিত্ব এ পরিবর্তনের পিছনে অনুঘটক। তাই ইতিহাস সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যক্তিত্বের কার্যক্রম এবং ঘটনার পরিবর্তনশীল নিয়ামকগুলােকে গভীরভাবে অধ্যয়নপূর্বক লিপিবদ্ধ করে থাকে। তাই পরিবর্তনশীলতা ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১৪. নিজস্ব গতিতে চলা : সূচনাকাল থেকে ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। এটির একটি নিরপেক্ষ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও গতি থাকায় এটির গ্রহণযােগ্যতা
আজও বর্তমান। উত্তরােত্তর এটির কলেবর তথা বিষয়সূচি সমৃদ্ধ হচ্ছে।
১৫. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি : পদ্ধতিগত দিক থেকে ইতিহাস প্রামাণিক তথ্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করে। বিজ্ঞান হিসেবে ইতিহাসের লক্ষ্য হলাে অতীতের বহু বিক্ষিপ্ত ঘটনা, তথ্য ও ব্যক্তির অবদানকে সময়ানুক্রমিকভাবে সন্নিবেশিত করা। এ ব্যাপারে ইতিহাসের প্রথম কাজ অতীতের বাস্তব ঘটনা ও তথ্যাদি যথারীতি অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করা এবং পরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। অর্থাৎ ইতিহাস বৈজ্ঞানিক
দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের দ্বারা কর্ম সম্পাদন করে থাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলাে।প্রণিধানযােগ্য। উপযুক্ত বৈশিষ্ট্য গুলাে ছাড়াও আরাে কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যায়
যেগুলাে কোন বিশেষ সময়, এলাকা, দিকের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রতিভাত হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url