রূপচর্চায় গ্লিসারিন এর ব্যবহার

চলছে এখন শীতের মৌসুম। শীতের পিঠা পুলি খাওয়ার পাশাপাশি এই সময়ে ত্বকের প্রতি অন্যান্য সময়ের চেয়ে একটু বেশী যত্নবান হওয়া উচিত। 
শীতকালে ত্বকে শুরু হয়  নানান রকমের সমস্যা। ঠোঁট ফেটে যাওয়া , হাত-পা ফেটে যাওয়া ছাড়াও ত্বকের  শুষ্কতা তো আছেই। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে  পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে ত্বকের আর্দ্রতা। আর এই ত্বকের আদ্রর্তা কমার সঙ্গে সঙ্গে কমে যায় ত্বকের মসৃনতা। তাই এই সময় ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখার একমাত্র অবলম্বন গ্লিসারিন। শুষ্ক ত্বকে প্রান ফিরিয়ে আনতে গ্লিসারিনের কোনো কোনো জুড়ি নেই। তবে চলুন, জেনে নেওয়া যাক,ত্বকের যত্নে গ্লিসারিন ব্যবহার এবং  এর উপকারিতা সম্পর্কে।


যত্নে থাকুক ঠোঁট:
ঠোঁটে গ্লিসারিনের সেই প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। শীতকালে ঠোঁট ফাটা দূর করতে গ্লিসারিনের কোনো তুলনাই হয় না। শীতকালে ঠোঁট জোড়া মসৃন রাখতে  রাতে ঘুমের আগে  এবং ঘুম থেকে উঠার পরে  গ্লিসারিন ব্যবহার করুন।
এছাড়াও শুষ্ক ঠোঁটকে সজীব করার জন্য   স্ক্রাবিং খুবই কার্যকরী একটি উপাদান। স্ক্রাবিং এর জন্য গ্লিসারিন খুবই কার্যকরী একটি উপাদান । এক চামচ চিনির সাথে পরিমান মত  গ্লিসারিন মেশান। খেয়াল রাখুন এটি যেন একটি ঘন মিশ্রণ তৈরি হয়। মিশ্রনটি আপনার ঠোঁট  ২-৩ মিনিট  আলতো করে ম্যাসাজ করুন। এতে যেমন আপনার  ঠোঁট ফাটা দূর হবে তেমনি  ঠোঁট হবে নরম।  গ্লিসারিনের টেক্সচার সাধারণত একটু ভারী হয়। সেক্ষেত্রে গোলাপজল  কিংবা সাধারন জলের সাথে গ্লিসারিন মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। তবে স্ক্রাবিং এর সময় অতিরিক্ত জোরে ঘষবেন না। এতে রক্তপাত হতে পারে।
সুন্দর হাত-পায়ের যত্নে:
শীতকালে হাত-পায়ের ত্বকের বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। তবে এই বাড়তি যত্নের জন্য আপনার অনেক উপাদানের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার হাতের কাছে থাকা গ্লিসারিন দিয়েই নিতে  পারেন আপনার হাত ও পায়ের ত্বকের এক্সট্রা কেয়ার।
শীতকালে হাত-পায়ের ত্বক নরম রাখতে চাইলে, একটি গামলায়  হালকা কুসুম গরম জল নিন। এবার এতে  হাফ চামচ গ্লিসারিন দিন এবং  ১০-১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এতে আপনার  হাত ও পায়ের ত্বক  নরম থাকবে এবং চামড়া ওঠে যাওয়া কিংবা গোড়ালি ফাটার মত সমস্যা চিরতরে বিদায় হবে।
অনেকেরই শীতকালে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশী পা ফাটার সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে রাতে ঘুমানোর আগে পা ভালো করে ধুয়ে নিন। এবার আপনার  গোড়ালি পরিষ্কার করুন এবং গ্লিসারিন লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। গ্লিসারিন যদি ঘন হয় তবে এর সঙ্গে অলিভ অয়েল সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন। এই রেমিডি নিয়মিত ব্যবহার করলে আপনার পা ফাটা খুব সহজেই দূর হবে এবং গোড়ালি হবে মসৃণ।
ফেইস প্যাকে গ্লিসারিন:
ফেইস প্যাক ব্যবহারের পর  ত্বকে এমনিতেই  একটু টানটান করে কিংবা ডিহাইড্রেটেড অনুভব হয়। আর শীতেকালে এই টানটান ভাবটা আরো বেশী অনূভুত হয়। এই টানটান ভাব দূর করার জন্য আপনার যেকোনো ফেইস প্যাকের সাথে কয়েক ফোঁটা গ্লিসারিন মিশিয়ে ব্যবহার করুন। গ্লিসারিনে অতিরিক্ত তেল থাকে না । তাই এটি  ত্বকে ময়েশ্চার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। যার ফলে যেকোনো প্যাক ব্যবহারের পরেও ত্বক থাকবে ডিহাইড্রেটেড ও কোমল।
টোনার এবং গ্লিসারিন:
টোনার হিসেবে গ্লিসারিন  বেশ  ভালো কাজ করে। দিন কিংবা মেইকাপের শুরুতে গ্লিসারিনের সাথে হালকা গোলাপজল কিংবা সাধারন জল  মিশিয়ে ব্যবহার করুন আপনার ফেইসে। যদি আপনি সারাদিন বাইরে থাকেন তবে এই মিশ্রণটি আপনার হাত ব্যাগেও ক্যারি করতে পারেন।এই মিশ্রণটি আপনাকে ত্বককে  সারাদিন জুড়ে রাখবে বেশ রিফ্রেশিং এবং হাইড্রেটেড।
বেইজ হিসেবে গ্লিসারিন:
শীতকালে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশী ড্রাই হয়ে থাকে। ত্যার ফলে যেকোনো ভারী বা হালকা মেকআপের আগে প্রয়োজন  একটি ভালো মানের ময়েশ্চারাইজারের।  মেকআপের আগে ত্বক ভালোকরে  পরিষ্কার করে নিয়ে গ্লিসারিন ব্যবহার করুন। এটি ত্বককে হাইড্রেট রাখবে এবং আপনার মেকআপকে  খুব সুন্দর করে ত্বকে বসে যেতে সাহায্য করবে।
ক্লিনজার:
ত্বককে একনে, প্রোন বা ব্রনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ক্লিনজার খুবই চমত্কার একটি উপাদান। মেকআপের আগে এবং পরে ক্লিনজার ব্যবহার করা খুবই জরুরি। যেকোনো ধরনের  স্কিনে গ্লিসারিন ক্লিনজার হিসেবে চমত্কার কাজ করে। এসময় গ্লিসারিন যুক্ত ফেসিয়াল ক্লিনজার ব্যবহার করা উচিত। এগুলো ত্বককে শুকিয়ে ফেলে না বরং  ত্বককে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। আপনার ব্যবহার করা ক্লিনজারটি ব্যবহার করে যদি আপনার ত্বকে শুষ্কতা অনুভব হয় তবে আপনার ব্যবহার্য ক্লিনজারটিতে সামান্য গ্লিসারিন মিশিয়ে ম্যাসাজ করে ধুয়ে ফেলুন।
গ্লিসারিন নিয়ে কিছু ভ্রান্তি ও কিছু প্রশ্ন:
কোন ধরনের ত্বকের জন্য  গ্লিসারিন উপযুক্ত?
স্কিন ড্রাই হোক কিংবা অয়েলি সব ধরনের ত্বকের জন্যই গ্লিসারিন উপযুক্ত। অনেকেই ভেবে থাকেন যে, যাদের স্কিন তৈলাক্ত এবং যাদের ত্বকে ব্রন রয়েছে তারা গ্লিসারিন ব্যবহার করতে পারবে না। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। গ্লিসারিনে কোনো এক্সট্রা অয়েল নেই। তাই এটি ত্বককে তৈলাক্ত করে তোলে না বরং এটি ত্বকের পোরস গুলোকে বন্ধ করে।  কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই আপনি আপনার  যেকোনো ত্বকে গ্লিসারিন  ব্যবহার করতে পারবেন।
কখন গ্লিসারিনের ব্যবহার করব ?
গোসলের পর গ্লিসারিন ব্যবহার করা সব থেকে ভালো সময় । কেননা এই সময়টিতে  আমাদের  ত্বক থাকে পরিষ্কার এবং শুষ্ক। তাই এ সময় গ্লিসারিন ব্যবহার করাই উত্তম । আমাদের শরীরের যে স্থান গুলো  বেশি শুষ্ক হয়, যেমন- হাতের কনুই,পায়ের গোড়ালি, ঠোঁট এইসব স্থানে দিনে কয়েক বার গ্লিসারিন ব্যবহার করতে পারেন।
গ্লিসারিন কাদের উপযোগী?
অনেকে ভেবে থাকেন গ্লিসারিন শুধু প্রাপ্ত বয়স্করা ব্যবহার করতে পারবে। আসলে এটি একদম ভুল ধারনা। গ্লিসারিন ছোট থেকে বড় যেকোনো বয়সী মানুষই ব্যবহার করতে পারবেন। গ্লিসারিন এ কোনো  রকম আর্টিফিশিয়াল পদার্থ ব্যবহার করা হয়না। তাই এটি সব বয়সের মানুষের জন্যই উপযোগী। 
চলুন জেনে নেই গ্লিসারিনের আরো কিছু কাজ:
 * শীতকিলে আমাদের স্কিনকে প্রাণবন্ত ও সতেজ রাখার জন্য  গ্লিসারিন অন্যবদ্য একটি উপাদান।
*শীতকালে আমাদের ত্বকে পিগমেন্টেশন দেখা দেয়।  স্কিনের পিগমেন্টেশনের সমস্যা বা দাগ দূর করার জন্য গ্লিসারিন চমত্কার কাজ করে থাকে।
শীতের ডেইলি স্কিন কেয়ারে গ্লিসারিন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
১) ত্বককে মূহূর্তেই  ময়েশ্চারাইজ করে।  বাহিরে আবহাওয়া  যেমনই হোক, বাহিরে থাকুন কিংবা ঘরে,  শীতকালে আমাদের স্কিন খুব দ্রুত আর্দ্রতা হারায়। গ্লিসারিন আপনার  ত্বকের এই হারিয়ে যাওয়া আর্দ্রতাকে খুব দ্রুত  ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। একই সাথে ত্বকের  নানা রকম সমস্যা রোধেও সহায়তা করে।
২)ত্বকের  অ্যান্টি এজিং সমস্যা রোধে কাজ করে।
শুষ্ক ত্বকে অয়েলি স্কিনের মানুষদের তুলনায় বয়সের ছাপ খুব দ্রুত পড়ে। তাই এই  সমস্যা হওয়ার আগেই এর সমাধান করা উচিত। আপনার এই সমস্যার সমাধান দেবে গ্লিসারিন। আপনার ডেইলি স্কিন কেয়ারে গ্লিসারিনের সঠিক ব্যবহার আপনাকে ত্বকের নানা সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে। 
৩) শীতকালে  সানবার্নের মত কঠিন সমস্যারও সমাধান দেবে গ্লিসারিন। অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে আমাদের  স্কিন রিলেটেড সমস্যা বহুগুণে বেড়ে যায়। আর এই সমস্যা গুলো সমাধানের জন্য আমরা অনেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকি। কিছু জেনে ব্যবহার করি , আর কিছু না জেনে। তবে আপনি যদি এত পদ্ধতি ব্যবহার না করে শুধু মাত্র উপরের নিয়মে গ্লিসারিন ব্যবহার করেন , তবে আফনি আপনার ত্বকের যেকোনো সমস্যা থেকে সহজে মুক্তি পাবেন। 
চলুন এবার জেনে আসা যাক , গ্লিসারিন  নিয়ে বিশেষ কিছু টিপস:
১) ত্বক শুষ্ক  থাকা অবস্থায় কখনই  গ্লিসারিন ব্যবহার করবেন না। ত্বকে ভেজা অবস্থায় গ্লিসারিন ব্যবহার করুন। এতে ত্বক নরম থাকবে।
২) ভাল রেজাল্টের জন্যে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার পরে এবং ঘুমানোর আগে , এই দুই বেলা গ্লিসারিন ব্যবহার করুন। এতে ত্বক কখনোই শুষ্ক হবে না।
৩) শীতকালে প্রায় সবার একটি কমন অভিযোগ হল, ত্বক শুষ্ক তাই অন্যান্য প্রোডাক্টস ভালভাবে বসেনা বা ভেঙে ভেঙে থাকে। এ সমস্যার সমাধান ও দেবে গ্লিসারিন। মুখ ভাল ভাবে পরিষ্কার  করে নিন। এবার অন্য যেকোনো প্রোডাক্ট ব্যবহারের আগে গ্লিসারিন  অ্যাপ্লাই করুন। এতে পরে আপনি যে পন্যই  ব্যবহার করুন না কেনো কোনো প্রোডাক্টই  আর ভেসে থাকবেনা।

প্রকৃতির নিয়মেই ঋতুর পালাবদল হয় এবং হবে। সেই সাথে আসে নানান রকমের সমস্যা ও। কিন্তু এজন্য জীবন যাত্রা কখনো থেমে থাকে এ না। শীতকালে একটি ভালো মানের গ্লিসারিন আপনাকে হাজার রকমের সমস্যার হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে। আশা করছি আজকের এই প্রবন্ধে আপনাদের গ্লিসারিন নিয়ে বিশেষ কিছু তথ্য জানাতে পেরেছি যা আপনাদের শীতকালের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url