রচনা: কাগজ, সভ্যতা বিস্তারের প্রধান উপকরণ।

 রচনা: কাগজ, সভ্যতা বিস্তারের প্রধান উপকরণ।

ভূমিকা : বর্তমান সভ্য জগতে কাগজ একটা বিশিষ্ট ভূমিকা বহন করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকাশ ও বিকাশের ক্ষেত্রে কাগজের অবদান অতুলনীয়। পৃথিবীর বিভিন্ন চিন্তাশীল, ভাবুক, কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের অমূল্য চিন্তাধারা এবং উপদেশাবলি কাগজ তার বক্ষে ধারণ করে অমর করে রেখেছে। কাগজ বিশ্বের বিদ্যানুরাগী নর-নারীর হৃদয়ের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। কাগজ মানব হৃদয়ের বন্যাকে পাঠাগারে কালো কালির আচরের মাধ্যমে বেঁধে রেখেছে। সুতরাং মানব সভ্যতার ইতিহাসে কাগজের আবিষ্কার সবকিছুর ওপরে।

রচনা: কাগজ, সভ্যতা বিস্তারের প্রধান উপকরণ।

পূর্ব ইতিহাস : আনোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মানবশিশু আপনার অন্তরের ইচ্ছা অপরের নিকট ব্যক্ত করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে প্রথম যেদিন মানবের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল, সেদিন থেকে তার সত্যানুভূতি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দূরের লাককে জানাবার জন্য, ভবিষ্যৎ বংশধরদের উদ্দেশ্যে সঞ্চিত করে রাখার জন্য, তার আকুলি-বিকুলির অন্ত ছিল না। অক্ষর আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে মানুষ চিত্রলিপির সাহায্যে মনের ভাব ব্যক্ত করতে শিখেছিল। তখন থেকে সে প্রস্তরফলক বা ধাতুখণ্ডের উপর ওইগুলো খোদিত করে রাখল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু চিত্রাঙ্কিত প্রস্তরফলক বর্তমানে নানা দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এদের অর্থও আবিষ্কার করেছেন। এসব চিত্র লিপি থেকেই ক্রমশ বর্ণমালা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাথমিক লিখন : কাগজ আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো বংশ পরম্পরায় কন্ঠস্থ করে রাখার চেষ্টা করে। ব্যবিলনের নিয়ে একপ্রকার কাগজ জাতীয় বস্তু প্রস্তুত করতে শিখল। গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় শরগাছকে বলা হয় 'প্যাপিরাস'— ইংরেজি অধিবাসীরা মাটির টালির ওপর অক্ষরগুলো খোদিত করে তা পুড়িয়ে নিত। এরূপে লক্ষ লক্ষ ইটের স্তুপে গ্রন্থাগার গড়ে ওঠত। পরবর্তী যুগে পাক-ভারতে ভূর্জপত্র ও তালপরে হস্তলিখিত পুঁথি রচিত হতে লাগল। এর কিছুদিন পরে মিসরীয়রা শরগাছের শাঁস 'পেপার' শব্দ তারই অপভ্রংশ। ইউরোপের সর্বত্র শরগাছ জন্মে না। তাই ইউরোপের অধিবাসীরা মেষ চর্মের ওপর গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করত। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মগ্রন্থ 'বাইবেল' মেঘের চামড়ায় লিখে দেশ-বিদেশে প্রচার করত। তবে এসব আদিম প্রক্রিয়া। বেশি লেখা এবং লেখার উন্নতি সাধন করা এতে কষ্টকর ছিল।

আবিষ্কার : কাগজের আবিষ্কার সম্পর্কে সঠিকভাবে কেউই কিছু বলতে পারে না। অনেকের ধারণা খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে চীনদেশে সর্বপ্রথম কাগজ আবিষ্কৃত হয়। আমাদের দেশে বহুকাল পর্যন্ত চীনা কাজ ও হাতের তৈরি তুলট কাগজের ব্যবহার ছিল। এরপর ইংল্যান্ডে কাগজ তৈরির কল আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে কলের সাহায্যে কাগজ প্রস্তুত করা শুরু হয়।

কাগজ প্রস্তুত প্রণালী : ছেড়া নেকড়া, ঘাস, পাটখড়ি, তুলা, বাঁশ, গাছ, গাছের ছাল ইত্যাদি কাগজ তৈরির প্রধান উপাদান। এসব জিনিসকে ভালো করে যন্ত্রের সাহায্যে মিহিন গুড়ায় পরিণত করা হয়। তারপর রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে গরম পানিসহ 'মণ্ড' তৈরি করা হয়। এ মণ্ড থেকেই মেশিনের সাহায্যে অতি পাতলা কাগজ তৈরি হয়।

প্রকারভেদ: বিভিন্ন ধরনের কাগজ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। এদের মধ্যে লেখার কাগজ, বই ছাপার কাগজ, সংবাদপত্রের কাগজ, মলাট ও প্যাকিং-এর কাপতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মতের সাথে বিভিন্ন রং মিশিয়ে নানাধরনের রঙিন কাগজ তৈরি হয়। তারপর ফুলস্কেপ, ডিমাই, ডবল ডিমাই, ক্রাউন ইত্যাদি সাইজে আনা হয়।

প্রয়োজনীয়তা : বর্তমান সভ্য জগতের সাথে কাগজের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাগজের যে কত প্রয়োজন তা বলে শেষ করা যায় না। বর্তমান যুগে লিখন কাজের একমাত্র বাহন কাগজ। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানবিস্তারে এর আবশ্যকতা অপরিসীম। এ কাগজেই বই-পুস্তক, সংবাদপত্র, সরকারি দলিল-পত্র, বাক্স, সুটকেস এমন কি বিরাট আকারের ঘর-দুয়ার তৈরি হচ্ছে। তাই কাগজেই আবিষ্কার বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের অন্যতম অবদান।

কাগজের মিল বা কারখানা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের দেশে কাগজের খুব সংকট সৃষ্টি হয়। এর পরবর্তীতে স্থাপিত হয়। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। বর্তমানে এ মিলে আমদানিকৃত কাগজের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নতমানের কাগজ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া পাবনার পাকশীতে একটি কাগজ কল, সিলেট একটি মণ্ড তৈরির কারখানা স্থাপিত হয়েছে। চন্দ্রঘোনায় রয়েছে কর্ণফুলী পেপার মিল। এ মিলে তৈরি হয় উন্নতমানের সাদা কাগজ। এ কাগজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে ঢাকা পেপার মিল, বসুন্ধরা পেপারমিল, সোনালি পেপার মিল এরকম আরো কয়েকটি বেসরকারি কাগজের মিল স্থাপিত হয়েছে। এসব মিলে উন্নত মানের কাগজ তৈরি হচ্ছে।

উপসংহার : কাগজ ব্যতীত বর্তমান সভ্যজগত কল্পনা করা যায় না। সামান্য এক টকুরা খবরের কাগজ বিশ্বের সংবাদ নিয়ে প্রতিদিন। আমাদে দ্বারে হাজির হয়। মোট কথা কাগজ বিশ্ব মানবের হৃদয়ে যোগসূত্র রচনা করেছে। মানব জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের একমাত্র বাহন কাগজ। এক কথায়, কাগজ বিশ্ব সভ্যতার একটা বিশিষ্ট অঙ্গ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url