বাংলাদেশ নামকরণ কিভাবে হয় বিস্তারিত আলোচনা - Naming of Bangladesh

ধারণা করা হয় বাংলা নামের উদ্ভব হয়েছে বঙ্গ থেকে। অনেকে মনে করেন বঙ্গ একটি প্রাচীন জাতির নাম। বঙ্গ নামের উল্লেখ প্রথম ‘ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থে পাওয়া যায়। সুতরাং জনপদটির প্রাচীন নিঃসন্দেহ। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে ‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে ‘আল’ শব্দ যােগ করে বঙ্গাল বা বাংলা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আল’ বলতে সীমা বা বাঁধ বুঝায়। অতীতে বঙ্গ প্রধানের পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি ১০ হাত উঁচু ও ২০ হাত চওড়া স্থূপকে ‘বাংলা' বলা হতাে।
বাংলাদেশের নামকরণ কিভাবে হয়
নীহাররঞ্জন রায় বলেন, বঙ্গ দেশে ‘আল’ অর্থাৎ এতদাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত যা আবুল ফজলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে তিনি বঙ্গের সঙ্গে ‘আল’ প্রত্যয় যােগ করে দেশের নাম রাখেন বঙ্গাল। অবশ্য রমেশ চন্দ্র মজুমদার এর পরিবর্তে বলেন,প্রাচীন শিলালিপিতে বঙ্গ ও বাশ নামে দুটি দেশ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে ড. নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস' গ্রন্থে বলেন, “উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয় হতে নেপাল,সিকিম ও ভূটান রাঙ্য, উল্লর পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভূমি; পূর্বদিকে গারাে-খাসিয়া-জয়ন্তিয়া- ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণি বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত, পশ্চিমে রাজমহল সাঁওতাল পরগনা-ছােটনাগপুর-মানভূম-ধলভূম-কেওঞ্জর-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই প্রাকৃতিক সীমাবিধূত ভূমিখণ্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার
গৌড়-পু-বরেন্দ্রীয়-রাঢ়-সূহ্ম-তাম্রলিপ্তি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ এটাই হলাে প্রাচীন বাংলার সীমানা। উপযুক্ত প্রেক্ষিতে বাংলার জনপদ গুলাের প্রাথমিক পরিচিত জানা প্রয়ােজন।প্রাচীন যুগে (খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতক পূর্ব সময় থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক, কোন কোন ক্ষেত্রে ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত) অভিন্ন বাংলা এখনকার বাংলাদেশের মতাে।কোন একক ও অখণ্ড রাষ্ট্র বা রাজ্য ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন অনেকগুলাে ছােট ছােট জনপদ বা অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। আর প্রতিটি অঞ্চলের শাসক যার যার
মতাে শাসন করতেন।চতুর্থ শতক হতে গুপ্ত যুগ, গুপ্ত পরবর্তী যুগ, পাল, সেন প্রভৃতি আমলের উৎকীর্ণ শিলালিপি ও সাহিত্য গ্রন্থে প্রাচীন বাংলার জনপদ গুলাের নাম পাওয়া যায়। এসব জনপদ ঠিক কোথায় কতখানি জায়গা জুড়ে ছিল তা বলা যায় না। তবে প্রাচীনকালের প্রাপ্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান হতে তাদের অবস্থান সম্বন্ধে মােটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। যথা :

১. গৌড়: গৌড় নামটি সুপরিচিত হলেও প্রাচীনকালে গৌড় বলতে ঠিক কোন অঞ্চলকে বুঝত এ নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছে। আর যে এলাকা গৌড় বলে অভিহিত
হতাে কেনই বা সে অঞ্চল এ নামে অভিহিত হতাে আজ পর্যন্ত সেটাও সঠিকভাবে জানা যায়নি। পাণিনির গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৌড়ের উল্লেখ দেখা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে গৌড় দেশের অনেক শিল্প ও কৃষিজাত দ্রব্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাৎসায়নের গ্রন্থেও
তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে গৌড়ের নাগরিকদের বিলাস-ব্যসনের পরিচয় পাওয়া যায়।হর্ষবর্ধনের শিলালিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, সমুদ্র উপকূল হতে গৌড়দেশ খুব বেশি দূরে অবস্থিত ছিল না। ষষ্ঠ শতকে লেখা বরাহ মিহিরের বিবরণ হতে দেখা যায় যে গৌড় অন্যান্য জনপদ,যেমন- পুঞ্জ, বঙ্গ, সমতট থেকে আলাদা একটি জনপদ।ভবিষ্য পুরাণ'-এ একে পদ্মা নদীর দক্ষিণে এবং বর্ধমানের উত্তরে অবস্থিত অঞ্চল বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ উক্তির সঙ্গে সপ্তম শতকের লােকদের বর্ণনার যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাঙ্কের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কর্ণসুবর্ণ । আর শুধু বা শশাঙ্কই কেন, পরবর্তীকালে আরাে অনেকের রাজধানী ছিল এই গৌড়। পাল রাজাদের আমলে গৌড়ের নাম-ডাক ছিল সবচেয়ে বেশি। উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল হওয়ায় তার প্রতাপ ছিল অপ্রতিহত। পরবর্তীকালে পাল সাম্রাজ্যের ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে গৌডের ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়ে যায় । গৌড়ের সীমা তখন সীমাবদ্ধ হয়ে আসে। আধুনিক মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশ গৌড়ের সীমানা বলে মনে করা হয়। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাঙ্কের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ ।
মুসলমান যুগের শুরুতে মালদহ জেলার লক্ষণাবতী গৌড় নামে অভিহিত হতাে। পরে গৌড় বলতে সমগ্র বাংলাকে বুঝাত।

২. বঙ্গ : বঙ্গ একটি অতি প্রাচীন জনপদ। অতি প্রাচীন পুঁথিতে একে মগধ ও কলিঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী বলা হয়েছে। মহাভারতের উল্লেখ হতে বুঝা যায় যে, বঙ্গ, পুণ্ড, তাম্রলিপ্ত ও সূহ্মের সংলগ্ন দেশ। চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য, চাণক্য দেব বা কৌটিল্য শ্যামলা ত্বক ফর্সা করার ৬ প্রাকৃতিক উপায়ও রাষ্ট্রকূটদের শিলালিপি এবং কালিদাসের গ্রন্থে এ জনপদের বর্ণনা পাওয়া যায়।
বর্তমান বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গ নামে একটি জনপদ গড়ে উঠেছিল।অনুমান করা হয়, এখানে 'বঙ্গ' নামে এক জাতি বাস করতাে। তাই জনপদটি পরিচিত হয় 'বঙ্গ' নামে। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে মনে হয়, গঙ্গা ও ভাগিরথীর মাঝখানের অঞ্চলকেই বঙ্গ বলা হতাে। পাল ও সেন বংশীয় রাজাদের আমলে বঙ্গের আয়তন সংকুচিত হয়ে পড়ে। একাদশ শতকে পাল বংশের শেষ পর্যায়ে বঙ্গ জনপদ দুভাগে।বিভক্ত হয়ে উত্তর বঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গ নামে পরিচিত হয়! পদ্মা ছিল উত্তরাঞ্চলের উত্তর সীমা, দক্ষিণের বদ্বীপ অঞ্চল ছিল দক্ষিণ বঙ্গ । পরবর্তীকালে কেশব সেন ও বিশ্বরূপ।সেনের আমলেও বঙ্গের দুটি ভাগ পরিলক্ষিত হয়। তবে এবার নাম আলাদা একটি ‘বিক্রমপুর' ও অপরটি ‘নাব্য'। প্রাচীন শিলালিপিতে বিক্রমপুর ও নাব্য' নামে বঙ্গের দুটি অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়। বর্তমান বিক্রমপুর পরগনা ও তার সাথে আধুনিক ইদিলপুর পরগনার কিয়দংশ নিয়ে ছিল বিক্রমপুর। নাব্য বলে বর্তমানে কোন জায়গার অস্তিত্ব নেই। ধারণা করা হয়, ফরিদপুর, বরিশাল, প্রাচীন পটুয়াখালীর নিম্ন জলাভূমি এ নাব্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৃহত্তর বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিমাঞ্চল,ঢাকা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বৃহত্তর কুমিল্লা ও নােয়াখালীর কিছু অংশ নিয়ে বঙ্গ গঠিত হয়েছিল। বঙ্গ’ থেকে ‘বাঙালি জাতির উৎপত্তি ঘটেছিল ।

৩.পুণ্ড : প্রাচীন বাংলার জনপদগুলাের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলাে পুণ্ড। বলা হয় যে, 'পু' বলে এক জাতি এ জনপদ গড়ে তুলেছিল। বৈদিক সাহিত্য ও মহাভারতে এ জাতির উল্লেখ আছে। পুদের রাজ্যের রাজধানীর নাম পুণ্ডনগর। পরবর্তীকালে এর নাম হয় মহাস্থানগড়। সম্ভবত মৌর্য সম্রাট অশােকের রাজত্বকালে (খ্রিঃ পূ: ২৭৩-২৩২ অব্দ) প্রাচীন পুণ্ড রাজ্য স্বাধীন সত্তা হারায়। সমৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে তা পুণ্ড্রবর্ধনে রূপান্তরিত হয়েছে। সে সময়কার পুণ্ড্রবর্ধন অন্তত বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। রাজমহল- গঙ্গা-ভাগীরথী হতে আরম্ভ করে করতােয়া পর্যন্ত মােটামুটি সমস্ত উত্তর বঙ্গই বােধহয় সে সময় পুণ্ড্রবর্ধনের অন্ততু ছিল। সেন আমলে পুণ্ড্রবর্ধনের দক্ষিণতম সীমা পদ্মা পেরিয়ে একেবারে খাড়।(বর্তমান চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা) ও ঢাকা-বরিশালের সমুদ্র তীর পর্যন্ত বিস্তৃত
ছিল। বগুড়া হতে সাত মাইল দূরে মহাস্থানগড় প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর ধ্বংসাবশেষ বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের দিক দিয়ে পুই ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাথরের চাকতিতে খােদাই করা সম্ভবত প্রাচীনতম শিলালিপি এখানে পাওয়া গেছে।

৪. হরিকেল : সাত শতকের লেখকের হরিকেল নামে অপর এক জনপদের বর্ণনা করেছেন। চীনা ভ্রমণকারী ইৎসিং বলেছেন, হরিকেল ছিল পূর্ব ভারতের শেষ
সীমায়। আবার কারাে কারাে লিপিতে হরিকেলের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বর্তমান চট্টগ্রামেরও অংশ খুঁজে পাওয়া যায়। সমস্ত তথ্য পর্যালােচনা করে ধরে নেয়া যায় যে, পূর্বে শ্রীহট্ট (সিলেট) থেকে চট্টগ্রামের অংশ বিশেষ পর্যন্ত হরিকেল জনপদ বিস্তৃত ছিল। যদিও মধ্যখানে সমতট রাজ্যের অবস্থিতি ছিল- যা কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আসলে তখন জনপদের কোথাও কোথাও বেশ শিথিল অবস্থা বিরাজ
করছিল। তা ছাড়া বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল- তিনটি পৃথক জনপদ হলেও এরা খুব নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় কখনাে কখনাে কোন কোন এলাকায় অন্য জনপদের প্রভাব বিরাজ করতাে বলে ধারণা করা হয়।প্রকৃতপক্ষে, সপ্তম ও অষ্টম শতক হতে দশ ও এগারাে শতক পর্যন্ত হরিকেল একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। কিন্তু পূর্ব-বাংলার চন্দ্র রাজবংশের রাজা ত্রৈলােক্যচন্দ্রের চন্দ্রদ্বীপ অধিকারের পর হতে হরিকেলকে মােটামুটি বঙ্গের অংশ বলে ধরা হয়। অনেকে আবার শুধু সিলেটের সাথে হরিকেলকে অভিন্ন বলে মনে করেন।


৫, সমতট : পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বঙ্গের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে ছিল সমতটের অবস্থান। এ অঞ্চলটি ছিল আর্দ্র নিম্নভূমি। কেউ কেউ মনে করেন সমতট বর্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম । আবার কেউ মনে করেন, কুমিল্লা ও নােয়াখালী অঞ্চল।নিয়ে সমতট গঠিত হয়েছিল। সাত শতক থেকে বারাে শতক পর্যন্ত বর্তমান ত্রিপুরা জেলা ছিল সমতটের অন্যতম অংশ। এক সময় এ জনপদের পশ্চিম সীমা চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে মেঘনার মােহনা পর্যন্ত সমুদ্র কূলবর্তী অঞ্চলকেই সম্ভবত বলা হতাে সমতট। কুমিল্লা

শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড় কামতা নামক স্থানটি সাত শতকে এর রাজধানী ছিল।

৬, বরেন্দ্র : বরেন্দ্রী, বরেন্দ্র বা বরেন্দ্র ভূমি নামে প্রাচীন বাংলায় অপর একটি জনপদের কথা জানা যায় । এটিও উত্তর বঙ্গের একটি জনপদ। বরেন্দ্র পুণ্ড্রবর্ধন
জনপদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল । জনপদের প্রধান শহর, মৌর্য ও গুপ্ত আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তার কেন্দ্র পুণ্ড্রনগরের অবস্থানও ছিল এই বরেন্দ্র এলাকায়। তাই একে জনপদ বলা যায় না। কিন্তু এ নামে এক সময় সমগ্র এলাকা পরিচিত হতাে। তাই প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে একে জনপদের মর্যাদা দেয়া হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, গঙ্গা ও করতােয়া নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল এ জনপদের অবস্থান। বগুড়া দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার অনেকটা অঞ্চল এবং সম্ভবত পাবনা জেলা জুড়ে বরেদ্রঅঞ্চল বিস্তৃত ছিল।

৭, তাম্রলিপ্ত : হরিকেলের উত্তরে অবস্থিত ছিল তাম্রলিপ্ত জনপদ। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুকই ছিল তাম্রলিপ্তের প্রাণকেন্দ্র। সমুদ্র উপকূলবর্তী এ এলাকা ছিল খুব নিচু ও আর্দ্র। নৌ চলাচলের জন্য জায়গাটি ছিল খুব উত্তম। প্রাচীনকালে তাম্রলিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। হুগলি ও রূপনারায়ণ নদের সঙ্গমস্থল হতে ১২ মাইল দূরে রূপনারায়ণের তীরে এ বন্দরটি অবস্থিত ছিল।
সাত শতক হতে এটি দণ্ডভুক্তি নামে পরিচিত হতে থাকে। আট শতকের পর হতেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সমৃদ্ধি নষ্ট হয়ে যায় ।

৮, চন্দ্রদ্বীপ : উপযুক্ত জনপদগুলাে ছাড়া আরাে একটি ক্ষুদ্র জনপদের নাম।প্রাচীন বাংলায় পাওয়া যায়। এটা হলাে চন্দ্রদ্বীপ। বর্তমান বরিশাল জেলাই ছিল চন্দ্রদ্বীপের মূল ভূখণ্ড ও প্রাণকেন্দ্র। এ প্রাচীন জনপদটি বলেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল।

এছাড়া বৃহত্তর প্রাচীন বাংলায় দণ্ডভুক্তি, উত্তর রাঢ় (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার পশ্চিমাংশ, সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা), দক্ষিণ রাঢ় (বর্তমান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলির বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা), বাংলা বা বাঙলা (সাধারণত খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীর সুন্দর বনাঞ্চল) ইত্যাদি নামেও শক্তিশালী জনপদ ছিল। এভাবে অতি প্রাচীন কাল হতে ছয়-সাত শতক পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। মূলত এটি ছিল রাজনৈতিক ও ভৌগােলিক বিভাগ। সপ্তম শতকের গােড়ার দিকে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজা হয়ে মুর্শিদাবাদ হতে
উল (উত্তর উড়িষ্যা) পর্যন্ত সমগ্র এলাকাকে সংঘবদ্ধ করেন। তারপর হতে বাংলা তিনটি জনপদ নামে পরিচিত হতাে। এগুলাে হলাে- পুণ্ড্রবর্ধন, গৌড় ও বঙ্গ। বাকি অন্যান্য জনপদগুলাে এ তিনটির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। বিভক্ত জনপদগুলােকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা পাল ও সেন রাজাদের আমলেই অনেকটা পরিপূর্ণতা লাভ করে। শশাঙ্ক এবং পাল রাজারা সমগ্র পশ্চিম বঙ্গের রাজা হয়েও ‘রাঢ়াধিপতি বা ‘গৌড়েশ্বর' বলেই পরিচয় দিতেন। ফলে, 'গৌড়' নামটি পরিচিতি লাভ করে। প্রাচীন বাংলার জনপদ হতে আমরা তখনকার বাংলার ভৌগােলিক অবয়ব, সীমারেখা,
রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে মােটামুটি ধারণা লাভ করতে পারি। প্রাচীন বাংলায় তখন কোন রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। শক্তিশালী শাসকগণ তাদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে একাধিক জনপদের শাসন ক্ষমতা লাভ করতেন। এভাবে জনপদগুলাে প্রাচীন বাংলায় প্রথম ভূখণ্ডগত ইউনিট বা প্রশাসনিক ইউনিট হিসাবে ভূমিকা পালন করে পরবর্তীতে রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে সহায়তা করেছিল। আব্দুল করিম একক বাংলা সম্পর্কে তার বই 'বাঙালা ও বাঙালি’ গ্রন্থে বলেন, “মুসলমান বিজয়ের পর বাংলার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি। এ সময়ে সুলতান শামস-উদ-দীন হালয়াল শাহ সম্পূর্ণ বাংলা জয় করে একচ্ছত্র সুলতান রূপে অধিষ্ঠিত হন। এই সময় তিনি শাহ-ই-বাঙ্গালা, শাহ-ই-বাঙালিয়ন এবং সুলতান-ই-বাঙালা রূপে পরিচিত করেন। মুঘল আমলে এটি 'সুবায়ে বাঙ্গালাহ’এ পরিণত হয়। পর্তুগিজদের কা”

বেঙ্গাল (Bengala) এবং ইংরেজদের লেখনিতে বেঙ্গল Bengal শব্দ ব্যাবহৃত হয়। আরাে পরে বেঙ্গল থেকে বাংলা এবং বর্তমানে বাংলাদেশ নামটি এসেছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url