রচনা: বৈশাখী মেলা, পহেলা বৈশাখ, গ্রাম্য মেলা

রচনাঃ বৈশাখী মেলা
অথবা, পহেলা বৈশাখ
অথবা, গ্রাম্য মেলা।

[সংকেত: ভূমিকা মেলার স্থান ও নামের প্রকৃতি বৈশাখী মেলা/পহেলা বৈশাখ —মেলার দৃশ্য মেলায় প্রাপ্ত জিনিসপত্র বৈশাখী মেলার গুরুত্ব ও অপকারিতা – উপসংহার]
পহেলা বৈশাখ
ভূমিকা; মেলা বাংলাদেশের একটি জাতীয় লােকজ ঐতিহ্য। মেলা' শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্মিলন। কোনাে পর্ব উপলক্ষে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে মেলা বসে থাকে। মেলা উপলক্ষে বহু লােকের সমাগম ঘটে সেখানে। এটি মূলত গ্রামের মানুষের শিল্প ও সংস্কৃতির অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ। গ্রামের মানুষের আনন্দ-উল্লাস এবং চিত্তবিনােদনের অন্যতম বাহন এটি। আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষের শুরুতে বা পহেলা বৈশাখে যে মেলা বসে তা বাঙালির সংস্কৃতির আদি বাহন। বাংলাদেশের উৎসবগুলাের মধ্যে বৈশাখী মেলা বা পহেলা বৈশাখ অন্যতম।

মেলার স্থান ও নামের প্রকৃতি : সাধারণ উন্মুক্ত জায়গায় যেখানে অনেক লােকের সমাবেশ ঘটে বা স্থানের সংকুলান হয়, যাতায়াত সুবিধা ভালাে এমন স্থানে মেলা বসে থাকে। গ্রামের পাশে, নদীর চরে, পূজা মণ্ডপের ধারে, স্কুল-কলেজের খেলার মাঠে, বটের ছায়ায়, উন্মুক্ত মাঠে, হাটে-বাজারে প্রভৃতি স্থানে মেলা বসে থাকে। মেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য থাকে স্বেচ্ছাসেবী ভলান্টিয়ার দল এবং মেলা কমিটি। তারা মেলার লােকজনের দেখাশােনা করে, কোথায় কোন দোকানের সারি বসবে তা নির্ধারণ করে। আর মেলার নামকরণ বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। যখন কোনাে পূজা উপলক্ষে মেলা হয় তখন তাকে সেই নামে ডাকা হয়, যখন কোনাে বিশেষ দিবস উপলক্ষে মেলা বসে তখন তা সে নামেই পরিচিত হয়। আবার যখন কোনাে নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ উদ্যোগে মেলা হয় তখন তা সেই স্থানের নামে পরিচিতি লাভ করে। যেমন : পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে হলে বৈশাখী মেলা, লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে হলে লক্ষ্মী পূজার মেলা, ভাষা দিবস উপলক্ষে হলে ভাষা মেলা, বই বেচাকেনা উপলক্ষে হলে বইমেলা ইত্যাদি। গ্রামের মতাে আবার শহরেও মেলা বসে। যেমন : বৈশাখী মেলা। এ মেলা বাংলাদেশের নববর্ষ উপলক্ষে হয় বলে তা একযােগে দেশের প্রায় সর্বত্র বসে।

বৈশাখী মেলা/পহেলা বৈশাখ : বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। এদেশের নানা উৎসবের মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য উৎসব হচ্ছে নববর্ষ উদ্যাপন বা পহেলা বৈশাখ। এ দিনে যে মেলা বসে তাকেই বলা হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা একদিনে শেষ হয়, আবার কোথাও কোথাও দু তিন বা তারও বেশি সময় ধরে চলে। নতুন বছরের আগমনে মানুষের মনে যে আনন্দ শিহরণ জাগে সে আনন্দ জাগরণের বহিঃপ্রকাশই বৈশাখী মেলা বা পহেলা বৈশাখ। এটি কোনাে বিশেষ ধৰ্মার্চনার মেলা নয়। এটি বাঙালির প্রাণের মেলা। জাতি-ধর্ম, ছােট-বড় নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ মনের টানে এ মেলায় আসে এবং আনন্দ উল্লাস করে। এই বৈশাখী মেলা কবে, কে, কেন চালু করেছিল তার হদিস পাওয়া যায় না। তবে এ মেলা যে এখন জাতীয় উৎসবে রূপ পেয়েছে, সার্বজনীনতা পেয়েছে এতে কোনাে সন্দেহ  নেই।

 মেলার দৃশ্য : বৈশাখী মেলার দৃশ্য বড় মনাে মুগ্ধকর। সকাল থেকে মেলায় লােকজন আসতে শুরু করে। ছেলে-বুড়াে, নারী-পুরুষ সর্বস্তরের মানুষ নববর্ষের আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে মেলায় আসে। মেয়েদের পরনে থাকে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি খােপায় পরা থাকে রঙ-বেরঙের ফুল। কেউ কেউ দল বেঁধে মেলায় আসে। জমিয়ে আড্ডা দেয়, ঘােরা-ফেরা করে, নেচে-গেয়ে আনন্দ ফুর্তি করে। আবার কেউ আসে কেনাবেচার পসরা নিয়ে। রােদ বাড়ার সাথে সাথে গরমে ধুলােয় সবই একাকার হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও মানুষের ক্লান্তি নেই। ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে মেলা গম গম করে। ছােট ছােট ছেলেমেয়ে মুখে নানা রঙের মুখােশ পরে নাচানাচি, আনন্দ-উল্লাস করে। বাশি ওয়ালা অসময়ে তােলে বাশির মধুর সুর। দিকে দিকে যেন ছড়িয়ে পড়ে সে মধুর সুর; জানিয়ে দেয় নববর্ষের আগমনী বার্তা। এছাড়া মেলার একদিকে বিশাল প্যান্ডেল বা আসর করে বসে যাত্রা, পালা, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বাউল, ব্যান্ড, সার্কাস, পুতুল নাচ প্রভৃতির আসর।লােকজন টিকিট করে অথবা বিনা পয়সায় যেভাবে দেখা যায়-এসব অনুষ্ঠান উপভােগ করে। সারাদিন ধুলাের সাগরে সাতরে মহা আনন্দের স্রোতে ভেসে সাঝের দিকে সবাই মুড়ি-মুড়কি, মিষ্টি-জিলাপি খেলনাপাতি, আরও কত নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি কিনে ঘরে ফেরে। গ্রাম-বাংলার মেলায় বসে গ্রামীণ জীবনের নানা আনন্দ-খেলার বাসর। যেমন : লাঠিখেলা, নাগর দোলা, গােলা খেলা, কুস্তি লড়াই ইত্যাদি। সব মিলে পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখী মেলা এক অপূর্ব দৃশ্যে দৃশ্যায়মান; যে দৃশ্য না দেখলে গ্রাম-বাংলার কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।

📚 রচনাঃ বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য

মেলায় প্রাপ্ত জিনিসপত্র : মেলা শুধু আনন্দ উৎসবের জন্যই নয়, তাতে মানুষের প্রয়ােজনও মেটে। মেলায় সকাল থেকেই দোকানীরা নানা পসরা সাজিয়ে বসে। মানুষ সারাদিন সখের ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় সব জিনিস পত্র কেনে। মেলায় এমন কতকগুলাে নিত্য নতুন পণ্যের আমদানি হয় যা সারা বছর হাট-বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। তাছাড়া মেলা উপলক্ষে সবাই সেখানে প্রচুর পণ্য ও খাদ্যদ্রব্য বেচতে নিয়ে যায় বলে সেখানে দামও কম হয়। আবার বিক্রেতার প্রচুর বিক্রি হয় বলে লাভও বেশি হয়। মেলায় বিচিত্র সব জিনিস পত্রের কেনাবেচা হয়। যেমন : বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন দ্রব্য, মুখরােচক নানা খাবার, ফলমূল, কৃষিজ দ্রব্য, আসবাবপত্র, অলঙ্কারাদি, মাটির হাঁড়ি পাতিল, খেলনা, পুতুল, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, পােশাক-আশাকসহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় প্রায় সব কিছুই মেলায় পাওয়া যায়।

📚 রচনাঃ অধ্যবসায়।

বৈশাখী মেলার গুরুত্ব ও অপকারিতা : বৈশাখী মেলা বা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন এদেশের সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনােদন ও অনাবিল আনন্দ উৎসবস্থল। কর্মব্যস্ত মানুষ একঘেয়েমি দূর করতে মেলায় আসে। বিভিন্ন পরিচিত অপরিচিত মানুষের সাক্ষাৎ মেলে মেলায়। সবার মধ্যে এক অদৃশ্য ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে ওঠে। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় হয়। জাতি-ধর্ম, সম্প্রদায়গত বিভেদ মেলায় এসে মানুষ ভুলে যায়। সব মিলে মেলার প্রয়ােজনীয়তা বা গুরুত্ব যথেষ্ট। অন্যদিকে আবার মেলার অপকারিতা এবং সম্প্রতি যােগ হয়েছে ভয়াবহতার দিক। মেলায় এসে পচা-বাসি খাবার খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। জুয়া খেলা, অশ্লীল যাত্রা, নৃত্য, সিনেমা-বায়ােস্কোপ ইত্যাদিও মেলার ক্ষতিকারক দিক। তাছাড়া সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন ধর্মান্ধ কিছু মানুষের বিধ্বংসী কর্মকান্ডে অনেকের প্রাণহানিও ঘটেছে। কিন্তু তারপরও মানুষ তাদের তােয়াক্কা না করে তাদের জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে মেলায় যায়, আনন্দ উৎসব করে। আর এখানেই পহেলা বৈশাখ, বৈশাখী মেলা বা বাংলা নববর্ষের বিজয় বা সফলতা।

উপসংহার : পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখী মেলার আনন্দ অবর্ণনীয়। দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বা মেলায় লােক সমাগম শুধু বাড়ছেই। আর এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, এ উৎসবটি বাঙালির জাতীয় চিন্তা-চেতনা, কৃষ্টি-কালচারের এক বিশেষ দিক; যা ধর্ম-বর্ণ ও সকল সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url