বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য ও তার প্রতিকার

নারী ও পুরুষ  লিঙ্গ ভেদে যে বৈষম্য আমাদের সমাজে বিরাজমান, তা যদি গভীর ভাবে পর্যালোচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীদের প্রতি নানামুখী অন্যায়-অত্যাচার এবং সহিংসতার মূল কারন এই জেন্ডার বৈষম্য। বাংলাদেশের শহর এবং গ্রামের  অসংখ্য পরিবারে ছেলে সন্তান জন্ম নিলে যে গর্ববোধ করা হয় মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তার  উল্টো চিত্র দেখা যায়। বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য ও তার প্রতিকার সম্পর্কে আমাদের সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে জেন্ডার বৈষম্যের কারণ হলো অগ্যতা ও কুশিক্ষা। এই জেন্ডার বৈষম্যের প্রভাব সমাজের বিশাল বিপর্যয় সাধন করতে পারে। কারন মানুষ হিসেবে একজন নারীর ও সমান অধিকার রয়েছে। তাই তাকে তার প্রাপ্ত অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।
জেন্ডার বৈষম্যের প্রভাব
ছেলে সন্তানকেই  পরিবারের উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং মেয়ে সন্তানকে শুধু মাত্র গৃহিনী রুপে বড় করা হয়। তাকে সেভাবেই প্রস্তুত করা হয়। একজন ছেলে শিশুকে যেভাবে স্বাধীনতা দেওয়া হয়, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে যেভাবে ছেলে সন্তানের প্রতি আচরণ করা হয় একটা মেয়ে শিশুকে কিন্তু তা দেওয়া হয় না।মেয়েদের শেখানো হয় তুমি মেয়ে মানুষ।  অর্থাৎ পারিবারিক ভাবেই এই জেন্ডার বৈষম্য তৈরি হয়। একটি ছেলে শিশু তার মা, বোন কিংবা খেলার সঙ্গী মেয়েটির তুলনায় নিজেকে বেশী প্রয়োজনীয় বা যোগ্যতা সম্পন্ন ভাবতে শিখে যায় এবং নারীদের ছোট করে দেখা শুরু করে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ছোট বেলা থেকেই গড়ে ওঠে  এবং এই মনোভাবটা ছড়িয়ে পড়ে পরিবার থেকে সমাজের সর্বস্তরে।

পরিবার, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা, সমাজব্যবস্থায় নারী-পুরুষের যে ভিন্নরকমের ও বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়, নারীর প্রতি অসম্মান এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এটি একটি অন্যতম কারণ। নারীকে অবলা এবং পুরুষের একচ্ছত্র মালিকানাধীন পন্য  ভাবার কারণেই নারীর প্রতি অশ্লীল বাক্য, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন কোনোটাই কমছে না। আজকে  আমরা প্রযুক্তিতে আধুনিক হচ্ছি , অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছি, শিক্ষিত হচ্ছি কিন্তু এখনো আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারি নি। 

যখন কোনো নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ বা অন্য কালরনে আলোচনায়  আসেন তখন আমরা দেখতে পাই, ওই নারীকে  সমবেদনা জানানোর  পাশাপাশি অনেক পুরুষ সেই আক্রান্ত নারীর চারিত্রিক দুর্বলতা খুঁজতে থাকেন। এমনকি নারীরা ও ওই ভুক্তভোগী নারীকে দোষারোপ করেন। কোনো নারীর বিরুদ্ধে  প্রথম যে অভিযোগ তোলা হয় তা হল " পর্দা না করা।" কিছু বিকৃত মানুষের কাছে নারী হল চকলেট কিংবা তেতুল সমতূল্য।  এদের বস্তা বন্দী করে রাখতে হবে, ঢেকে রাখতে হবে। নয়তো যদি তারা ধর্ষন হয় এতে পুরুষের কোনো দায় নেই। অর্থাত যত নিয়ম, যত ধর্মীয় আচার সব নারিদের জন্য বরাদ্দ। পুরুষ যত অপরাধ করুক না কেন তবু পুরুষ ধোয়া তুলসী পাতা।

নারীর প্রতি শ্রদ্ধার অভাব বা নির্যাতনের মূল কারণই হল পারিবারিক বৈষম্যে। নারী পুরুষের এই বৈষম্য সবচেয়ে বেশী পরিলেক্ষিত হয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারে। পারিবারিক সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার না থাকা নারীর প্রতি বৈষম্যের এক চরম উদাহরন। যার ফলে এক জন নারী সচেতন বা অবচেতন মনে নিজেকে দুর্বল ভাবা শুরু করে।  সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি অধিকার থাকায় একজন পুরুষ স্বাভাবিক ভাবেই  নিজেকে নারীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী, ক্ষমতাবান এবং  যোগ্য ভাবতে শুরু করেন।

আমাদের সামাজিক, পারিবারিক  প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে হলে আমাদের কয়েকটি  বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে: 
* পারিবারিক এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে নারীর সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।কোনো নারী বা মেয়ে যেন  স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র কিংবা পারিবারিক পরিবেশে  কোনও ধরনের হয়রানিমূলক আচরণ করা না হয় তার জন্য শিক্ষা,সামাজিকব্যবস্থা  ও পারিবারিক পরিবেশে  নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে ।

*প্রাত্যহিক জীবনে ছেলে শিশু এবং মেয়ে শিশুকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পারিবারিক শিক্ষা দিতে হবে। 

*যে কোনো ধরনের বৈষম্য নিরশনে পারিবারিক মূল্যবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিশু তার পরিবার থেকেই আসল শিক্ষা লাভ করে।পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যদি পরিবারের  নারীদের সত্যিকার অর্থে সম্মান করতে শেখার অভ্যাসটা গড়ে তুলতে পারেন, তবে সেই পরিবারের ছেলে শিশুটি ও নারীকে সম্মান করতে শিখবে । 

*নারীকে পণ্য , অবলা , ঢেকে রাখার বস্তু হিসেবে তুলনা করা বন্ধ করতে হবে। কথিত ধর্ম প্রচারের নামে ওয়াজে প্রকাশ্যে নারীদের অবমাননা,তেতুল ,কলা , চকলেট প্রভৃতি বন্ধ করতে হবে এবং এদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

*পারিবারিক সম্পত্তিতে নারী পুরুষ উভয়কে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে কোনো ভাবেই তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বন্ঞ্চিত করা যাবে না। কর্মক্ষেত্রে নারী যেন তার প্রাপ্য মর্যাদা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। 

শুধুমাত্র আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে বা প্রতিবাদ করে  নারীর প্রতি চলমান বৈষম্য বন্ধ করা যাবে না। যতদিন না  নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে ততদিন এই বৈষম্য থাকবেই। নারীকে নিজেকে তার নিজের শক্তি হতে হবে। নিজেকে মেয়ে মানুষ নয় শুধু মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নিজের ছেলে সন্তান ও মেয়ে সন্তান কে একই ভাবে বড় করতে হবে, কাউকে বেশী কাউকে কম এই পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হবে। তবেই এই বৈষম্য বন্ধ হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url