ইতিহাসের বিষয়বস্তু বা ইতিহাসের পরিধি

ইতিহাসের বিষয়বস্তু বা ইতিহাসের পরিধি - Subject Matter or Scope of History. ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একজন ঐতিহাসিক যে বিষয় গুলাের উপর জোর দিয়ে।
প্রাচীনকালে ইতিহাস বলতে বুঝানাে হতাে কোন দেশ, সমাজ বা সাম্রাজ্যের উত্থান- পতনের বর্ণনাকে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রাজা-বাদশার শাসনামল, সিংহাসনের
উত্তরাধিকার, যুদ্ধ, সন্ধি, দিন-তারিখ, জয়-পরাজয়, চুক্তি ও চুক্তি ভঙ্গ ইত্যাদি হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের আলােচ্যবিষয়। সেখানে সাধারণ প্রজা-সাধারণ বা শাসিত শােষিতের সম্পর্কের বর্ণনার পরিবর্তে স্থান পেত কেবল রাজা-বাদশা বা শাসকের জীবন, বিলাসব্যসন, সুখ-দুঃখ, কীর্তি-কাহিনী। ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠভাবে চিন্তা ও গবেষণার কাজে যার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ্য তিনি হলেন সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম জনক আরবীয় দার্শনিক ইবনে খালদুন। তিনি তার গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দিমায় বলেন,


“ইতিহাস হচ্ছে মানবসমাজ ও সভ্যতার বিশ্লেষণ। মানুষের কাজ, পেশা, জীবনধারণ, সামাজিকতা, সামাজিক সংহতি, বিপ্লব, শাসক শ্রেণির উত্থান-পতন তথা সমাজ পরিবর্তনের বর্ণনা ইতিহাসের আলােচ্য বিষয়।”

মানুষ, তার সমাজ ও মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত অতীত কর্মের প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাস মানব জাতির এমন বিবর্তনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড এক সঠিক ও সুবিন্যস্তভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একজন ঐতিহাসিক যে বিষয় গুলাের উপর জোর দিয়ে থাকেন সেগুলাে নিম্নে আলােচনা করা হলাে :

১. মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তন : ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে মানুষের উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশেষ করে মানব জীবাশ্ম থেকে মানব বিবর্তনের ইতিহাস পাওয়া যায়।

২, সভ্যতার ক্রমবিবর্তন : সভ্যতা হলাে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজ যেখানে বস্তুগত সংস্কৃতির আধিক্য ও মননশীল চিন্তার লালন ও বিকাশ করা হয়। সে সভ্যতা সমূহ কোথায়, কিভাবে, কখন গড়ে উঠেছিল তাও ইতিহাসের বিষয়বস্তু।

৩. ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ : ভূপ্রকৃতি হলাে কোন এলাকার মাটির গঠন তথা সে এলাকার মাটি আঠালাে না বালুকাময়, পাহাড়ি না সমতল ইত্যাদি বিষয়গুলাে। আর পরিবেশ হলাে প্রাকৃতিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সমাহার যার মধ্যে রয়েছে আবহাওয়া, জলবায়, তথা ভৌগােলিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। আর সামাজিক পরিবেশ হলাে মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা আর এসবই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।

৪. যুগ বিভাজন : ইতিহাস যেহেতু অতীতের ঘটনার সমাহার। তাই বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলাে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা সাপেক্ষে মানব ইতিহাসকে বিভিন্ন
আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগসহ বিভিন্ন যুগে ভাগ করে আলােচনা করা হয়।

৫. প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন : প্রত্নতত্ত্ব হলাে অতীত ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ সাপেক্ষে সে সমাজের সংস্কৃতি ও জীবনধারা সম্পর্কে জানার শাস্ত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে অতীতের ধ্বংসাবশেষ এর মধ্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন বস্তুগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র।

৬, শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তন : ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু হলাে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের, দেশের ও অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা। সেটা কি একনায়কতান্ত্রিক, না
রাজতান্ত্রিক না অন্য কোন ব্যবস্থায় তার বর্ণনা।

৭. অর্থনৈতিক প্রভাব ও সংগঠন : অতীতকালের অর্থনৈতিক সংগঠন ব্যবস্থা ও কার্যাবলি এবং তার ফলে সমাজের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়ে তাও ইতিহাসের আলােচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

৮, ধর্মীয় ক্রমবিকাশ : ধর্ম হলাে মানুষের চাইতে উচ্চতর শক্তিতে বিশ্বাস এবং সে শক্তির আরাধনা। সমাজের রীতিনীতি ও জীবনধারার উপর ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব বিবেচ্য। এ ধর্মগুলাের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং ধর্মের প্রভাবও ইতিহাসের আলােচ্য বিষয় ভূক্ত।

৯. অতীতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড : ইংরেজ ঐতিহাসিক Freeman ইতিহাসকে 'Past Politics' হিসেবে অভিহিত করেছেন। মূলত আগেকার আমলে
ইতিহাসকে রাজ-রাজড়াদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হতাে। বর্তমানেও এর গুরুত্ব কিছুমাত্র না কমে বরং সাধারণ জনগণের উপর উল্লিখিতদের কার্যক্রমের প্রভাবকেও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

১০. সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড : সংস্কৃতি হলাে একটি সমাজের সামগ্রিক জীবনধারা যার মধ্যে পড়ে বস্তুগত এবং অবস্তুগত সমস্ত বিষয়ের সমাহার। এর মধ্যে এক দিকে যেমন মানুষের বাসস্থান, পােশাক-পরিচ্ছদসহ ব্যবহার্য বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে তেমনি মানুষের চিন্তা, আচার-আচরণ, মূল্যবােধ, বিশ্বাস ও বস্তুগত দ্রব্য
ব্যবহারের রীতিও। অর্থাৎ মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্ত কার্যক্রমই এর মধ্যে পড়ে।

১১. নদ-নদী ও সমুদ্র : যােগাযােগ ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক কার্যাবলির অন্যতম মাধ্যম হলাে নদী ও সমুদ্র। একটি দেশের মধ্যে নদী ও সমুদ্রের অবস্থান তাদের জীবন। ও জীবিকাকে অনেকখানি প্রভাবিত করে। পৃথিবীর কোন নদী, কোন সাগর কোথায় অবস্থিত তা উক্ত দেশ বা জাতির ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত।
( ১২. লেখক, দার্শনিক, আবিষ্কারক ও তাদের কর্ম : কোন সমাজের বা জাতির উপরে সে সমাজের দার্শনিক, লেখক, আবিষ্কারক ও তাদের কর্ম যেমন বিশেষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তেমনি তা কোন সময় এমন প্রভাবশালী হয় যে তা সারা বিশ্বকেও প্রভাবিত করে থাকে। তাই অনেকক্ষেত্রে ইতিহাসটির ভিত্তি হয়ে যায় লেখক, দার্শনিক, আবিষ্কারক ভিত্তিকও।

১৩. সংস্কার ও সংস্কারক : সংস্কারের মাধ্যমে কোন সমাজের অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন অপসংস্কৃতি তথা ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে। তেমনি সে সংস্কারের যারা অগ্রপথিক তাদের কার্যক্রমও ইতিহাস বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে থাকে।

১৪. উত্থান-পতন : কোন জাতির উত্থান-পতন বলতে মূলত শাসনতান্ত্রিক বিভিন্ন পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু ইতিহাসের মধ্যে কোন সভ্যতার উত্থান-পতন এবং পরিবর্তনও এর অন্তর্ভুক্ত।

১৫. আন্দোলন ও যুদ্ধবিগ্রহ : আন্দোলন হলাে নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য মানুষের ধারাবাহিক আবেদন। মানুষ যখন তাদের অধিকার ও প্রাপ্তির বিষয়টির মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখতে পায় তখন তারা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে তা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে। আবার আন্দোলনের বিষয়টি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় তখন যুদ্ধবিগ্রহের সূত্রপাত হয়। আবার অন্যান্য যুদ্ধ যেমন- ধর্মযুদ্ধ, আধিপত্যবাদী যুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধ ইত্যাদি এর বিষয়বস্তুর মধ্যে পড়ে।

১৬. সম্মেলন ও চুক্তি : বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি দেশের অভ্যন্তরে আবার দেশের বাহিরে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলন এবং প্রায় প্রতিটি সম্মেলনের মাধ্যমে যেসব চুক্তি হয়ে থাকে সেসবও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url