রচনা: নিরক্ষরতা দূরীকরণ অথবা, সাক্ষরতা আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ

রচনা: নিরক্ষরতা দূরীকরণ
অথবা, বয়স্ক শিক্ষা অনুচ্ছেদ রচনা
অথবা, সাক্ষরতা অভিযান রচনা
অথবা, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রচনা
অথবা, সাক্ষরতা আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
অথবা, নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজের ভূমিকা
অথবা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও ছাত্রসমাজ
অথবা, নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায়



(সংকেত: ভূমিকা - বিজ্ঞানের বিস্ময় ও নিরক্ষরতার অভিশাপ - নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় - উপসংহার)
নিরক্ষরতা দূরীকরণ

ভূমিকা : বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করে লিখেছিলেন-“ছয় কোটি ষাট লক্ষের ক্রন্দন ধ্বনিতে আকাশ যে ফাটিয়া যাইতেছে- বাঙ্গালার লােক যে শিখিল না, বাঙ্গালায় লােক যে শিক্ষিত হয় নাই; ইহা সুশিক্ষিত বুঝেন না।” বস্তুত শিক্ষাই সব সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক এবং অর্থনৈতিক তাবৎ অমঙ্গল নিবারণের উপায়। অশিক্ষাই বৈষম্যকে, তাবৎ দুঃখকে স্থায়ী করে। তাই নিরক্ষরতা যে কোনাে দেশের, যে কোনাে জাতির পক্ষেই এক নিদারুণ অভিশাপ ।


বিজ্ঞানের বিস্ময় ও নিরক্ষরতার অভিশাপ : স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে ১৯৭১ সালে। কিন্তু বিশ্ব সমাজে বাংলাদেশ এখনাে মর্যাদাবান জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। জাতি হিসেবে আমরা এখনও ব্যাপক অনগ্রসর। আর এর জন্য যত গুলো সমস্যাকে চিহ্নিত করা যায় নিরক্ষরতা তার মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে এদেশে শতকরা প্রায় ৭৭ জন লােক নিরক্ষর। এর মধ্যে নারীশিক্ষার হার খুবই শ্লথ। সমগ্র পৃথিবীতে নিরক্ষরের সংখ্যা যেখানে ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে শতকরা ৩৪ থেকে কমে প্রায় ২২ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে; সেখানে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্ছিত এ কথা ভাবতে অবাক লাগে। অথচ এ পৃথিবীর মানুষ ইতােমধ্যেই আবিষ্কার করেছে পারমাণবিক বােমা, আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। তারা নক্ষত্র যুদ্ধের ভয়ঙ্কর প্রস্তুতি নিচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে অভাবনীয় সাফল্যের অধিকারী হয়েছে, চাঁদে মানুষ নামিয়েছে, মঙ্গলগ্রহে অভিযান চালিয়েছে, মহাকাশে দীর্ঘকাল অবস্থানের রহস্য আয়ত্ত করেছে। সেই পৃথিবীর মাটির ওপর, সেই বিজ্ঞান সাধনার গৌরবময় যুগে যাদের বাস, তারা নিরক্ষর; তারা লিখতে পড়তে জানে না, নিজের নাম সই করতে জানে না। তারা বৃহৎ জগৎ তাে দূরের কথা, নিজের দেশের ব্যক্তির কোনাে সন্ধান রাখে এও সত্য; নিদারুণ সত্য । এ বেদনা, এ অপমান আজ অসহনীয়। এ যেন আত্মঘাতী ছিন্নমস্তা-মূর্তি।

নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায় : নিরক্ষরতার এ চিত্র মেনে নেওয়া যায় না। আর তাই ইতােমধ্যে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা মূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঝাপিয়ে পড়েছে নিরক্ষরমুক্ত দেশ গঠনের আন্দোলনে। এ আন্দোলন চলছে বিভিন্ন ভাবে। যথা,

ক) সরকারি প্রচেষ্টা : নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন : গণশিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতা মূলক এবং অবৈতনিককরণ। তাছাড়া 'মিনা' কার্টুনের মাধ্যমেও শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বহুবিধ তথ্য বেতার এবং টেলিভিশনে প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার ব্যাপক কার্যক্রম চালানাে হচ্ছে।

খ) বেসরকারি প্রচেষ্টা : সাক্ষরতা আন্দোলন কর্মসূচিকে সফল করার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকাও ব্যাপক। তবে আমাদের দেশে কয়েকটি এনজিও নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচি চালালেও এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে উল্লেখ করার মতাে কর্মসূচি চোখে পড়ে না। তবে এ ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রচেষ্টা খুবই জরুরি।


গ) ছাত্রসমাজের ভূমিকা : নিরক্ষরতা দূরীকরণে একটি দেশের ছাত্রসমাজ সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির সভাপতি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড, সত্যেন্দ্রনাথ সেনের বক্তব্য তুলে ধরা দরকার। ১৯৭৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসে তিনি ঘােষণা করেছিলেন– “ছাত্র শিক্ষকদের অকুণ্ঠ ও জোরালাে সহযােগিতা ছাড়া নিরক্ষরতা দূর করা সম্ভবই নয়। ছাত্রদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাধ্যতামূলকভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়ােজন হলে তার জন্য আইন প্রণয়ন করা প্রয়ােজন। তিনি আরাে বলেন, বিশেষত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এই কার্যক্রমে পরিপূর্ণ ভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই দেশের মধ্য থেকে নিরক্ষরতাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিশাল ভূমিকা ছাত্রসমাজই কেবল রাখতে পারে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, বহু বছর আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রদের প্রতি সমভাষণ’ লেখায় দেশের শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে ছাত্রদের অফুরন্ত উৎসাহ, কর্মোদ্দীপনা ও মানসিক শক্তিকে অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। 'অপমান (নামার দুর্ভাগা দেশ’) কবিতায় তিনি লিখেছিলেন,

“অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে/তােমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘাের ব্যবধান।"

অতএব দেশ ও জাতির কল্যাণে ছাত্র সমাজের নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া একান্ত কাম্য। আর নিরক্ষরতা দূরিকরনে ছাত্র সমাজ দুটি পর্যায়ে এগুতে পারে। যথা : ক. ব্যক্তিগত পর্যায়ে, খ, সমষ্টিগত পর্যায়ে। মূলত স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। দীর্ঘকালীন ছুটি পাওয়া যায় তখন ছাত্ররা দল বেঁধে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাময়িক অক্ষর-শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। তাছাজা তারা ব্যক্তিগত ভাবে যদি প্রত্যেকে একজন করেও অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তােলে তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশের সমাজতার দ্বারা প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশে এসে দাঁড়াবে। তাই ছাত্রদের এখনই এ সামাজিক আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া উচিত।


উপসংহার : নিরক্ষরতা আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত। এ দেশ সাফল্যের সিড়ি বেয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে কখনও পৌছতে পারবে না। তাই অনতিবিলম্বে এ ব্যাপারে সম্মিলিত প্রয়াস নিতে হবে ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url