জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি? এর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

আমাদের আজকের আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে বায়োটেকনোলজি সাবজেক্টের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (Genetic Engineering)। আমরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কি, গুরুত্ব  এর সম্ভাবনা ও বাস্তবতা এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কিভাবে মানুষকে সহায়তা দিচ্ছে এবং ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ কি এসকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো!
Genetic Engineering
এই তাে কদিন আগে আমাদের দেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম পাটের জিন মানচিত্র আবিষ্কার করে আমাদের গর্বের অংশীদার হওয়ার সুযােগ করে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে। স্বাভাবিকভাবে সন্তানের চেহারা মা-বাবার মতাে হয় কারণ সন্তানের শরীরে থাকে মা-বাবার জিন। পৃথিবীর প্রত্যেকটি জীবের আকার, বৈশিষ্ট্য কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করে দেয় তার জিন।

কখনাে ভেবে দেখেছ কি, আমরা যে খাবার খাই সেটা ধীরে ধীরে আমাদের শরীরেরই অংশ হয়ে যায়? এই হজম প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে থাকে নানান রকম প্রােটিন, আর এই প্রােটিন তৈরির নির্দেশ দেয় জিন। হয়তাে মানুষ এখন চাইলে ঠিক তার মতাে আরেকজন মানুষ ক্লোন করে ফেলতে পারবে জিনপ্রযুক্তি ব্যবহার করে। কিন্তু এই জিন জিনিস টা আসলে কী, আর এটি কীভাবেই বা কাজ করে?

তােমরা তাে জানাে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হলাে অণু । আর এই অণুকে ভাঙলে এর আরও ক্ষুদ্রতম অংশ দেখতে পাব, যাকে আমরা বলি পরমাণু । কোনােভাবে যদি আমরা পরমাণুকে ভাঙতে পারি তবে আমরা কী পাব জানাে? আমরা পাব আরও ক্ষুদ্রতম অংশ, আর এই অংশগুলাে হলাে ইলেকট্রন, নিউট্রন ও প্রােটন ।

তেমনি আমাদের জীবদেহের (উদ্ভিদ ও প্রাণী) সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয় কোষ (Cell)। মূলত আমাদের দেহও অনেকগুলাে কোষ দ্বারা তৈরি। এই কোষের মাঝে একটি প্রাণকেন্দ্র থাকে। একে নিউক্লিয়াস বলে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এই নিউক্লিয়াস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এর ভেতর কিছু পেঁচানাে বস্তু রয়েছে। এদেরকে ক্রোমােসােম বলে। জীবভেদে ক্রোমােসােমের সংখ্যা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।

যেমন— প্রতি সেলে আমাদের শরীরে থাকে ২৩ জোড়া ক্রোমােসােম, মশার থাকে ৬ জোড়া আর বিড়ালের থাকে ৩৪ জোড়া ক্রোমােসােম। এদের মধ্যে এক জোড়া ক্রোমােসােম থাকে যা আমাদের বংশবাহক হিসেবে কাজ করে। আমাদের শরীরের এই ক্রোমােসােমগুলাের অর্ধেক এসেছে বাবার শুক্রাণু থেকে আর বাকি অর্ধেক এসেছে মায়ের ডিম্বাণু থেকে।
Dna pic
শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায়, ক্রোমােসােমের মধ্যে আবার কিছু চেইনের মতাে পেঁচানাে কিছু জিনিস রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এটাকে ডিএনএ (DNA-Deoxyribonucleic Acid) নাম করণ করল। DNA এর একটি ক্ষুদ্র অংশ হলাে জিন। প্রতিটি ক্রোমােসােমে শত শত থেকে হাজার হাজার জিন থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে, এই জিন কী কাজ করে? প্রত্যেকটি জিন একটি করে নির্দিষ্ট এনজাইম প্রস্তুতের জন্য দায়ী। আমরা যে খাবার খাই, এনজাইম সে খাবারকে ভেঙে গ্লুকোজে রূপান্তর করে আমাদের শক্তি জোগায়।

বহু বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা আশাই করতে পারেননি যে, কোনাে একদিন উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর জিন তত্ত্বে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশ গুলাে নিয়ে কাজ করা যাবে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করলেন একটি সরল ক্ষুদ্র জীব নিয়ে, যা আমাদের আশেপাশেই কোটি কোটি পরিমাণে পাওয়া যায়। এর নাম Escherechia Coli সংক্ষেপে E-Coli। মানুষ ও বানরের মতাে প্রাণীর পেটের অন্ত্রে এই ব্যাকটেরিয়া গুলাে বেড়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর DNA অংশ কেটে আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া যায়। জোড়া দেয়ার পর যা হয় সেটা খুবই অদ্ভুত হতে পারে। সবচেয়ে বেশি যে কাজটি করা হয় তা হলাে E-Coli-এর মতাে ব্যাকটেরিয়ার জিনে মানুষের জিন লাগিয়ে দেয়া। এভাবে নতুন যে DNA পাওয়া যায় তাকে বলে রিকম্বিনেন্ট DNA।
মূলত DNA কেটে এবং জোড়া লাগানাের বিষয়টি হলাে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং । ১৯৭৩ সালে হার্ভার্ট বয়ার ও স্ট্যানলি কোহেন দুটি একই ধরনের ডিএনএ গঠনের ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে হতে প্লাসমিড সংগ্রহ করে তা অন্যটিতে স্থাপন করতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে একই পদ্ধতিতে ব্যাঙের ও ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে তা বাস্তবায়নে সক্ষম হন। এ সময়টিকে আধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শুরু হিসেবে ধরা যায়। জিন জোড়া লাগানােটা অর্থাৎ রিকম্বিনেট DNA বা RDNA সত্যিকার অর্থে কী উপকারী হতে পারে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, DNA এর মধ্যে কী থাকে? DNA এর মধ্যে থাকে ডি-অক্সিরাইবােজ নামে একটি সুগার, প্রচুর পরিমাণে ফসফেট আর চার প্রকার ক্ষারক। এই ক্ষারকগুলােকে সংক্ষেপে A,C,G,T নামে ডাকা হয়। এই ক্ষারকগুলাের বিন্যাস ও সমাবেশ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। আর এ সকলের জন্য আমাদের একেক জনের চেহারা একেক রকম। ক্ষারক গুলাের সাজানাের পদ্ধতিকে জিন ম্যাপিং বলে । জীবপ্রযুক্তির বিশেষ রূপ হিসেবে কোষ কেন্দ্রের জিনকণার পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবদেহের গুণগত পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটানােই হলাে জিন প্রকৌশল বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হলাে জীবপ্রযুক্তির একটি অত্যাধুনিক শাখা যার মাধ্যমে কোনাে জীবের কাঙ্ক্ষিত জিন (DNA) পৃথক করে অন্য জীবের জিনের সাথে সংযুক্ত করে নতুন জিন বা DNA তৈরি করা হয়। এতে জীবের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। এভাবে সৃষ্ট DNA কে রিকম্বিনেন্ট DNA বা RDNA বলে এবং এই প্রযুক্তিকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। অর্থাৎ নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির জন্য কোনাে জীবের ডিএনএ-এর পরিবর্তন ঘটানােই হলাে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উদ্দেশ্য।

অন্যভাবে বলা যায় জীবদেহের জিনােমকে প্রয়ােজন অনুযায়ী সাজিয়ে নেয়া অথবা একাধিক জীবের জিনােমকে জোড়া লাগিয়ে নতুন জীবকোষ সৃষ্টির কৌশলকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বলে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রয়ােজনীয়তা :
তােমরা জান যে, বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটির উপরে। বৃহৎ এ জনগােষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণ আমাদের প্রচলিত উৎপাদনব্যবস্থায় সম্ভব হচ্ছে না। ঘাটতি মেটাতে খাদ্য আমদানিতে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। এ জন্য বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি একটি সময় উপযােগী আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। আমরা সাধারণভাবে এ বিষয়টি হাইব্রিড নামে চিনে থাকি। আধুনিক জীবপ্রযুক্তি বা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে জিন স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কাক্ষিত বৈশিষ্ট্য অল্প সময়ে সূচারুভাবে স্থানান্তর করা সম্ভব হয় বলে সংশ্লিষ্ট উদ্ভাবক বা উদ্যোক্তাগণের নিকট প্রচলিত প্রজননের তুলনায় এ প্রযুক্তিটি অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের দেশেও এ প্রযুক্তির ওপর বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে, যেমন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাশ গবেষণা ইনস্টিটিউট, আখ গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি সম্প্রতি সারা পৃথিবীতে যে সাফল্যটি বাংলাদেশ অর্জন করেছে তা হলাে পাটের জিনােম সিকুয়েন্স আবিষ্কার। আর এ কাজটি করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট পাট গবেষণাবিদ মাকসুদুল আলম ও তার দল।

☑ ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা!

এতে করে পাট পৃথিবীর সােনালি আঁশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলােতেও এ বিষয়ে বর্তমানে উল্লেখযােগ্য শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। নতুন ফসল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রজননের তুলনায় জিন প্রকৌশল অধিক কার্যকর। কারণ প্রচলিত প্রজনন প্রক্রিয়ায় জিন স্থানান্তর একই অথবা খুব নিকটবর্তী প্রজাতির মাঝে সীমাবদ্ধ, কিন্তু জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী যেকোনাে প্রজাতির মাঝে এক বা একাধিক জিন সরাসরি স্থানান্তর করা সম্ভব। প্রচলিত প্রজননে কাঙিক্ষত ফলাফল অর্জন করতে দীর্ঘ সময় প্রয়ােজন। পক্ষান্তরে জিন প্রকৌশলের সাহায্যে অতিদ্রুত কাঙিক্ষত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ বা প্রাণী বা অণুজীব পাওয়া সম্ভব ।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবহার :
১. শস্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভুট্টা, ধান, তুলা, টমেটো, পেঁপে ইত্যাদির জিন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, ভাইরাস প্রতিরােধক্ষমতা বৃদ্ধি, আগাছা সহিষ্ণু, পােকামাকড় প্রতিরােধী, লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল। ফসলের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

২. প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রাণীর আকার ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি, দুধে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি, ভেড়ার পশমের পরিমাণ বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে জিন স্থানান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
৩. চিকিৎসা ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে পরিবর্তিত E-Coli ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট হতে মানববৃদ্ধির হরমােন এবং গ্রেনােলুসাইট ম্যাকরােফাজ কলােনি উদ্দীপক উপাদান ইত্যাদি তৈরি করা হচ্ছে। এতে করে বেঁটে, ভাইরাসজনিত রােগ, ক্যান্সার, এইডস ইত্যাদির চিকিৎসায় উল্লেখযােগ্য উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ভাবে মানবদেহের ইনসুলিন তৈরির জন্য কৌশলগতভাবে পরিবর্তিত E-Coli ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট ব্যবহার করা হচ্ছে।

৪. মৎস্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্যামন মাছের বৃদ্ধি হরমােনের জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে কৌশলগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মাগুর, কমন কার্প, তেলাপিয়া জাতীয় বিভিন্ন মাছের আকৃতি প্রায় ৬০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।

৫. পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে ড. এম কে চক্রবর্তী যুক্তরাষ্ট্রে জিন প্রকৌশলের ওপর গবেষণা করে নতুন এক জাতের সুডােমােনাস ব্যাকটেরিয়া তৈরি করেছেন যা পরিবেশের তেল ও হাইড্রোকার্বনকে দ্রুত নষ্ট করতে সক্ষম। এ ছাড়া পেট্রোলিয়াম ও কয়লাখনি এলাকার দূষণ, শিল্পক্ষেত্রের বর্জ্য শােধন, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সহজ ও দ্রুত করার উদ্দেশ্যে এ প্রযুক্তি ব্যবহার কর হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url