রচনা: ভূমিকম্প

রচনা: ভূমিকম্প

সংকেত : ভূমিকা-ভূমিকম্প কী-ভূমিকম্পের কারণসমূহ-মানবসৃষ্ট কারণ-ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ-ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগ-বাংলাদেশে ভূমিকম্পের অবস্থা-ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাসমূহ-গণসচেতনা সৃষ্টি-উপসংহার ।
ভূমিকম্প রচনা
ভূমিকম্প রচনা
ভূমিকা : অন্তহীন যাত্রাপথে নিরন্তর বয়ে চলেছে মানুষ। যে চলার বিরতি নেই, নেই পিছুটান । মহাকালের সেই নিরবধি প্রবাহে ক্ষণবন্দি মানুষের জীবন। প্রকৃতিকে শাসন করে নিজের উদ্যমতাকে প্রকাশ করতে সদা ব্যস্ত এই মানুষগুলাে। কিন্তু প্রকৃতি বড় নিষ্ঠুর বড় নির্মম মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সৃষ্টি করছে নানা দুর্যোগ। আধুনিক বিশ্বের মানুষকে বড় ভাবিয়ে তুলেছে এমনি এক দুর্যোগ যার নাম ভূমিকম্প। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতাে বাংলাদেশেও ভূমিকম্প হানা দিয়ে চলেছে। সমগ্র মানুষের মধ্যে একটি ভীতিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভূমিকম্প অধ্যুষিত এলাকার জনগণ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবেলা করে জীবন মৃত্যুর শাশ্বত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে আসছে।

ভূমিকম্প কী : ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূঅভ্যন্তরে দ্রুত শক্তি বিমুক্ত হওয়ায় পৃথিবী পৃষ্ঠে যে ঝাকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে ভূমিকম্প বলে। ভূঅভ্যন্তরে যেখানে শক্তি বিমুক্ত হয় তাকে কেন্দ্র বলে। আর এই কেন্দ্র থেকে ভূকম্পন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্প বিভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে। যখন ভূমিকম্পের যাত্রা কম থাকে তখন ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণনাশ কম হয়। কিন্তু যখন মাত্রা বেশি থাকে তখন বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণনাশ ঘটে। ভূমিকম্পে কোনাে কোনাে সময় ভূপৃষ্ঠের কোনাে কোনাে অংশ নিচের দিকে চলে যায় । আবার কোনাে কোনাে অংশ উপরের দিকে উঠে যায়। আর এভাবেই বিশাল সমুদ্রের বুকে দ্বীপের আবির্ভাব ঘটে আবার কোনাে কোনাে দ্বীপ
সমুদ্রতলে বিলীন হয়ে যায়।

📘 রচনা- বেকার সমস্যা ও প্রতিকার।

ভূমিকম্পের কারণসমূহ : পৃথিবীতে সচরাচর ভূমিকম্প হয়ে থাকে এর কারণ সম্পর্কে ইতােপূর্বে বহু কল্পকথা প্রচলতি ছিল। এমনটি ছিল যে, একটি দৈত্যের শিঙের উপর পুরাে পৃথিবী দাঁড়িয়ে ছিল, দৈত্যটি মাথা নাড়ালে ভূমিকম্প অনুভূত হতাে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এর কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা ও তথ্য রয়েছে।

ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এ দুর্যোগের কারণ—
১। ভূঅভ্যন্তরের প্লেটগুলাের স্থানচ্যুতি ঘটলে ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
২। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ভূমিকম্প হয়।
৩। সমুদ্রতলদেশের ভূত্র নিচে নেমে গেলে ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
৪। ভূভাগের কোথাও ফাটলের সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
৫। পৃথিবীর কোথাও কোথাও পাহাড়ি ভূমিধসের ফলে পার্শ্ববর্তী এলাকা ভূমিকম্পের কবলে পড়ে ।
৬। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

📘 রচনা- শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা

মানবসৃষ্ট কারণ : ভূমিকম্পকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মানবসৃষ্ট কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। মানবসৃষ্ট কারণ গুলাে হলাে বিল্ডিং কোর্ড ছাড়াই বড় বড় বিল্ডিং তৈরি করা, খনিজ তরলের জন্য কূপ খনন এবং কূপে খনিজ তরল ফেলে রাখা, কয়লার খনি এবং প্রাকৃতিক তেল খনন করা প্রভৃতি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ২০০৮ সালের মে মাসে চীনে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহতার দিক থেকে চীনের এ ভূমিকম্প ১৯তম। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পও মানবসৃষ্ট এবং এ ভূমিকম্প হয় কয়লা খনির জন্য।

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ : ভূমিকম্পের মতাে একটি অনির্দিষ্ট ও দৈব ঘটনার পরিণতি পরিমাপ করা সহজ নয়। আবার যথােপযুক্ত পদ্ধতিও নেই। ঢাকাতে মৃদু ও মাঝারি মাপের ভূমিকম্প, অনেক বারই অনুভূত হয়েছে এবং সাম্প্রতিককালেও হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে প্রকৌশলীরা বলেছেন, ৬ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং বাকি ৭০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুরানাে ঢাকাতে ক্ষতি হবে আরাে বেশি। উল্টো ব্যাপারও হতে পারে । ঢাকাতে বহুবার ভূমিকম্প হয়েছে। তারপরও পুরানাে ঢাকা টিকে আছে। নতুন ঢাকা যে ভেজাল প্রক্রিয়ায় নির্মিত হচ্ছে, তাতে মনে হয় বিপদ এখানেই বেশি। একটি নগর ভূমিকম্প দ্বারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করে ওর সহ্য ক্ষমতার উপর। যেটা প্রযুক্তি, নির্মাণ রীতি, দুর্নীতি, আইন এবং সামগ্রিক পরিকল্পনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ভূমিকম্পে নগরের কাঠামােগত দুর্যোগের সাথে সাথে লাইফ লাইনও ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংস হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট ও গ্যাস বিস্ফোরণ প্রভৃতি থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ভূমিকম্পের সহযােগী দুর্যোগ। ইতােমধ্যে স্বাভাবিক সময়ের গ্যাস ও পয়ংপ্রণালির বিস্ফোরণ, শর্ট সার্কিট থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মতাে ঘটনা ঢাকাতে ঘটেছে। ভূমিকম্পের মতাে দুর্যোগের আরেকটি অনুসরণ বিশৃঙ্খলা, মারামারি ও লুটতরাজ। পরবর্তী পর্যায় আসে অভাব অনটনসহ দীর্ঘ মেয়াদি সামাজিক দুর্যোগ। এসময় অর্থনীতি এবং প্রশাসন ব্যবস্থাও অচল হয়ে পড়বে এমনকি শহরটি পরিত্যক্ত হওয়াই স্বাভাবিক।

📘 রচনা- বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য।

ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগ : ভূমিকম্পে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি তাে হয়ই। এছাড়াও বিভিন্ন দুর্যোগের আবির্ভাব ঘটে। যেমন- সুনামি, বন্যা প্রভৃতি। ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের পানি ফুলে ফেঁপে উঠে তার তীরবর্তী শহর বা গ্রামকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।ভূমিকম্পের ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ক্ষতি হয়। বিভিন্ন রােগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, মানুষের নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসের অভাব ঘটে। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট বন্যা ও সুনামি ফসলের ক্ষতি করে এবং এতে অনেক প্রাণহানি ঘটে।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের অবস্থা : বস্তুত ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে ‘সিসমিক গ্যাপের কোনাে অংশে । ভূমণ্ডলীয় প্লেট টেকটোনিকস এর বিন্যাস এবং ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার বণ্টন মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান না থাকলেও দূরে নয় । হিমালয়ের উত্থান প্রক্রিয়া এখনাে সক্রিয় বিধায় এটি একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভূমণ্ডলীয় আঞ্চলিক সিসমিক জোনের পূর্বপ্রান্ত রেখাটি ঢাকার পূর্বপাশ দিয়ে চলে গেছে। ১৯৭৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব্ বাংলাদেশ পুরােদেশকে তিনটি ভাগে ভাগ করে সিসমিক জোনিং ম্যাপ তৈরি করে। এই ম্যাপে ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ জোন হিসেবে দেখানাে হয়েছে। এটি ঢাকার জন্য একটি দূরবর্তী সংকেত। মাইক্রো লেভেলেও দেখা যায়, ঢাকা মহানগরী এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকার ভূগঠন অস্থিতিশীল এবং ভূআলােড়ন জনিত ক্রিয়াকলাপের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঢাকা প্লাইস্টোসিনকালে গঠিত মধুপুর চত্বর ভূমির একটি অবিচ্ছিন্ন অংশ। ঢাকার আশেপাশেই রয়েছে কতকগুলাে অস্থিতিশীল ভূতাত্ত্বিক অল। উত্তরে সিলেট অববাহিকা, যা বেশ দ্রুতগতিতে ভূঅভ্যন্তরে নিমজ্জিত হচ্ছে। বিগত কয়েক শতকে এ অঞ্চলটি ১১ মিটারের মতাে দেবে গেছে; পশ্চিমে যমুনা উপত্যকা অঞ্চলটি ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে; দক্ষিণে বৃহত্তম ঢাকা অবনমন, যা সাম্প্রতি কালে বার্ষিক ১.৮২ মি. মি. হারে নিমজ্জিত হচ্ছে।
এসব অস্থিতিশীল ভূতাত্ত্বিক অঞ্চলের প্রভাব নিশ্চিত ভাবেই ঢাকা মহানগরীর ওপর পড়বে। ঢাকা মহানগরীর খুব কাছাকাছি রয়েছে দুটো শক্তিশালী ভূকম্পনকেন্দ্র, যথাক্রমে মধুপুর ও বনসি চ্যুত এলাকা। যা থেকে রিখটার স্কেলে ৫.৯ থেকে ৭.০ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে। এমনকি ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অংশে চ্যুতি এবং দীর্ঘ ও সংকীর্ণ প্রান্তরেখা দৃশ্যমান। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলাে টঙ্গী চ্যুতি, বুড়িগঙ্গা প্রান্ত রেখা, উত্তরার পশ্চিমাংশের অবনমনের প্রান্তরেখা, পল্লবী অবনমনের প্রান্তরেখা, খিলক্ষেত ও যাত্রাবাড়ির প্রান্তরেখা এবং মােহাম্মদপুর প্রান্তরেখা প্রভৃতি। ঢাকাতে স্থানবিশেষ পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বাের্ডের তথ্যে দেখা যায়, বিগত ৩০ বছরে ভূগর্ভস্থ এই পানিস্তরের উচ্চতা ৩০ মি. হ্রাস পেয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রস্থলের পানি উত্তোলন বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের প্রবাহ পরিবর্তিত হওয়া এবং পানি স্তরের হ্রাসের ফলে ভূতত্ত্ব ও মৃত্তিকার গুণাগুণও পরিবর্তিত হতে পারে। এর পরিণতিতে স্থানবিশেষ দেবে যাওয়ার ঘটনা এবং ভূমিকম্পের পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে। ওয়াসার তথ্য মতে, আগামী ২০ বছরে ঢাকার স্বাভাবিক উচ্চতা কমে যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরের ক্ষেত্রে উচ্চতা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলেও, ঢাকার ক্ষেত্রে এ ধরনের আশঙ্কা সন্দেহমুক্ত নয়। প্রবল মৌসুমি বৃষ্টিপাতে বন্যা এবং চারদিকে নদী ও খালবিলের পানি হতে ভূগর্ভ পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। তবে ঢাকা যেভাবে গড়ে উঠেছে, জলাশয় এবং উন্মুক্ত স্থান যেহারে নষ্ট করা হচ্ছে এবং যেহারে ভূগর্ভের পানি তােলা হচ্ছে, তাতে মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে ভূগর্ভ পূরণ হওয়ার হার হ্রাস পেতে পারে এবং ভূমিকম্পের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। তবে ঢাকাসহ বাংলাদেশে বহুসংখ্যক মৃদু কম্পন অনুভূত হয়েছে। বিগত ১৫০ বছরের রেকর্ডে বাংলাদেশে প্রধান ৭টি ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে। এগুলাের মধ্যে দুটোর উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। অন্যদিকে বিগত দুই শতকে ঢাকা মহানগরী অন্তত ৬ বার যথাক্রমে ১৭৬২, ১৭৭৫, ১৮১৮, ১৮৭৬, ১৮৮৫ ও ১৮৯৭ সালে মাঝারি হতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল। ঢাকাতে বহু ঘরবাড়ি ও দালান-কোঠা বিধ্বস্ত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ৫১বার মৃদু ও মাঝারি কম্পন হয় এবং ২০০০ সালে ৬ বার মাঝারি কম্পন অনুভূত হয়। এর মধ্যে ঢাকাও ছিল। চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের একমাত্র সিসমিক যন্ত্রে প্রতি বছর গড়ে ৪০টি মৃদু কম্পন রেকর্ড করা হয়। সাধারণভাবে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র মাঝারি এবং মৃদু ভূমিকম্পের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এর বেশিরভাগ উৎপত্তি স্থল দেশের বাইরে। ভূমিকম্পের ধারাক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শতাব্দীতে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং কোনাে অঞ্চলে বড় মাপের ভূমিকম্প হওয়ার আগে ঘন ঘন মৃদু কম্পন অনুভূত হয়ে থাকে। ভূমিকম্পের এই প্রাক পরিস্থিতিকে ঘুমােটভাব বলে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ঢাকাসহ সারা দেশেই এই পরিস্থিতি বিদ্যমান। সম্প্রতি ভূমিকম্প শীর্ষক সেমিনারে প্রকৌশলীরা বলেছেন, উপমহাদেশে প্রতি একশ বছর পরপর ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে। ভূমিকম্প মূলত নগরকেন্দ্রিক,অপরিকল্পিত এবং ভুল পরিকল্পিত নগর বিকাশের দরুন ভূমিকম্প ভয়াবহ রূপ নিতে পারে । ঢাকার বাণিজ্যিক বহুতল ভবনগুলাের অবস্থান মতিঝিলে। পূর্বে এটি ঝিল ছিল এবং ভূ-গঠনও দুর্বল। এসব এলাকা সাধারণ ভূমিকম্পেও বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ঢাকা শহরে যেভাবে দালান-কোঠা তৈরি হচ্ছে, উন্মুক্ত জমি যেহারে দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, ভূমিকম্প হলে বেরিয়ে আসার কোনাে জায়গাও হয়তাে থাকবে না, চাপা পড়তে হবে সকলকে।

ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাসমূহ : সাম্প্রতিককালে বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলাের মধ্যে চিলি, পেরু, ইরান, পাকিস্তান, পর্তুগালের অ্যাজোরেস, তুর্কি, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়া এবং জাপান বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য। কিন্তু ভূমিকম্প পৃথিবীর সর্বত্র হতে পারে যেমন : নিউইয়র্ক সিটি, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি। বড় ধরনের ভূমিকম্প সচরাচর হয় না। এক গণনার মাধ্যমে দেখা গেছে যে, ৩.৭ থেকে ৪.৬ মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিবছর হয়। তাছাড়া ৪.৭ থেকে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প প্রতি একশ বছরে একবার হয়। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা গুলাের কোনাে না কোনােটা প্রায় প্রতি বছর ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণনাশের ঘটনা ঘটে থাকে। পৃথিবীতে যত বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে তার অধিকাংশই ৪০,০০০ কিলােমিটার এলাকা জুড়ে অনুভূত হয়েছে। পৃথিবীতে যে হারে মেগাসিটি বাড়ছে। তাতে ভূ-কম্পন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এক ভূমিকম্পে তিন মিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রাণনাশ ঘটতে পারে।

গণসচেতনতা সৃষ্টি : ভূমিকম্পের মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখােমুখি হওয়ার মতাে অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, মানসিকতা আমাদের নেই। ভূমিকম্প আমাদের মূলধারার কোনাে প্রপঞ্চ নয়, যেমনটা জাপানিদের। ওরা কাগজের ঘর বানায়, স্প্রিং কাঠামাে, ইনটেলিজেন্ট স্ট্রাকচার বানিয়েছে। একেই বলে রিফ্লেকশন এ্যাকশন। কোনাে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবিলায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তােলা সবচেয়ে উত্তম। ভূমিকম্পের বেলায় সঙ্গত কারণেই এটা আমাদের হয়ে উঠেনি এক্ষেত্রে প্রয়ােজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানাে। প্রচার মাধ্যম, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে এটা করতে হবে। স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে প্রস্তুতিমূলক বিষয় গুলাে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার । ভূমিকম্পের সচেতনতার জন্য ঢাকার চারদিকে গ্রামাঞ্চলে স্যাটেলাইট ক্লিনিং, ব্লাড ব্যাংক স্থাপন; ক্ষতিগ্রস্ত দেশের বিপদ মােকাবিলার অভিজ্ঞতা অর্জন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তােলা দরকার। যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং মহড়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ধারা বজায় রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানাে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগ আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম শত্রু। এজন্য সেনাবাহিনীকে প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দান, প্রয়ােজনীয় সরঞ্জামাদি ও নির্দেশ প্রদান এবং আলাদা সেলও গঠন করা যেতে পার । অন্যান্য দুর্যোগের মতাে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও প্রাক-মধ্যবর্তী-পরবর্তী, এই তিন ধরনের প্রস্তুতি প্রয়ােজন। প্রাক-পরিকল্পনা, ভবন নির্মাণের আধুনিক প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত দিক যথাযথ ভাবে অনুশীলন করা দরকার। নগরের পার্শ্বিক ও উলম্ব উভয় প্রকার বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূ-প্রাকৃতিক যাবতীয় বিষয় গুলাে আধুনিক অবজারভেটরির মাধ্যমে জরিপ ও মানচিত্রায়ণ করে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিধি-নিষেধ আরােপ করা প্রয়ােজন। দুর্যোগােত্তর মােকাবিলায় আন্তর্জাতিক সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত প্রতিবেশী দেশগুলাের সাথে ভূমিকম্প বিষয়ে একটি সহযােগিতা মূলক নীতিমালা ও কার্যক্রম আগেভাগেই গড়ে তােলা দরকার। এক্ষেত্রে সার্ক ফোরাম কাজে লাগানাে যেতে পারে। ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত জনগােষ্ঠীর বাহ্যিক ক্ষয়ক্ষতিই চোখে পড়ে এবং আমরা ত্রাণ, চিকিৎসা ও অন্যান্য সাহায্যের মাধ্যমে তা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ঐ জনগােষ্ঠীর অন্ত্রস্থ বা মানসিক ক্ষতির কথা আদৌ ভাবি না। অথচ দুর্যোগ পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরজীবীদের দুর্বল ও ভগ্ন মানসিকতার পুনর্গঠনও প্রয়ােজন । ত্রাণ সাহায্য দেয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের দীর্ঘমেয়াদি সাইকোথেরাপির সুবিধাও দেয়া দরকার।

উপসংহার : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু প্রকৃতির সৃষ্ট দুর্যোগের কাছে মানুষ বড় অসহায়। তার প্রমাণ মেলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ রােধ করা সম্ভব নয়। জীবনের প্রতিটি পদে দুর্যোগ অভিযােজনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারলে এবং পূর্ব সংকেত অনুযায়ী যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলে ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url